সিজন-১, পর্ব# ১
গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে নগ্ন দেহে সে তার রুমে প্রবেশ করে বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়ালো। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতাবিশিষ্ট, ছোট করে ছাটা চুল, চর্বিহীন পেট আর পেশিবহুল শরীরের নিজেকে দেখতে মাহবুবের বেশ লাগে। ছাব্বিশ বছর বয়স। নিয়মিত জিম করে। বাসাতেই একটা রুমে ব্যায়াম করার সকল সরঞ্জাম নিয়ে ব্যক্তিগত জিম গড়ে তুলেছে সে। কটকটে হলুদ রঙের টাওয়ালের সাহায্যে সারা শরীরের পানি শুষে নিয়ে সে তার স্ত্রীর রুমের দিকে এগুতে থাকলো।
নুসরাতকে তার নিজের রুমে থাকার জায়গা মাহবুব বিয়ের প্রথম রাতে একদিনই দিয়েছিল। এই মেয়ে কিছুতেই তার সাথে শোবার যোগ্য না। যে মেয়ের প্রতি সে কখনোই কোনো আবেগ অনুভব করেনি, যে মেয়ের সাথে কথা বলার ইচ্ছেটুকুও তার কখনো হয়নি তাকে কিছুতেই সে তার রুমে থাকতে বা তার বিছানার ভাগ দিতে পারে না। নুসরাতকে বিয়ে করেছে সে বাধ্য হয়ে।
তিনটা চা বাগান আর শ্রীমঙ্গল এলাকায় কয়েকটা রিসোর্টের মালিক রায়হান সাহেব নিজ পছন্দমতোই তার দুই ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন। তিনি মনে করেন, তার ছেলেরা তাদের নিজেদের জন্য পছন্দের মানুষ খুঁজে নিতে ভুল করবে। তিনি বিশেষ চিন্তিত ছিলেন মাহবুবকে নিয়ে। অল্প বয়সে বখে যাওয়া মাহবুবকে তার ইচ্ছেমতো বিয়ে করার স্বাধীনতা কিছুতেই দেয়া যায় না এটা তিনি বেশ ভালো করেই বুঝেছিলেন। তাই বিয়ে করানোর সময় তিনি মাহবুবের মতামত নেয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি। প্রয়োজন বোধ করেননি তার মায়ের মতামত নেয়ারও । অঢেল প্রাচুর্য্যের অধিকারী এই মানুষটি কারো মতামতের তোয়াক্কা কখনোই করেননি। বিয়ের সময় মাহবুব কিছুটা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল। তার অপছন্দের কথা তার মাকে জানিয়েছিল। কিন্তু রায়হান সাহেব যখন বলেছেন, এই মেয়ের সাথে ঘর না করলে তার কোনো সম্পত্তিই তার ছোট ছেলে পাবে না, তখন আর কোনো প্রতিবাদ মাহবুব করেনি।
রাধানগর চা বাগানের পাদদেশে এই দ্বিতল ভবনটি রায়হান সাহেব তার ছোট ছেলের বিয়েতে উপহার হিসেবে দিয়েছেন। একটা ফ্ল্যাট তিনি বড় ছেলেকেও দিয়েছেন। কিন্তু মাহবুবের ফ্ল্যাটটি অনেক সুন্দর, অনেক বেশি আধুনিক। ছাদে সুইমিং পুলের উপস্থিতি এই ভবনটির সৌন্দর্য অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। মাহবুব বেশ ভালো করে জানে, নুসরাতকে তার বাবা-মা দুজনই খুব পছন্দ করেন বলেই এই অত্যাধুনিক ও বিলাসবহুল বাড়িটি রায়হান সাহেব মাহবুবের জন্য বরাদ্দ করেছেন। নুসরাতের সার্বক্ষনিক দেখাশুনার জন্য আদুরি নামের এইচএসসি পাশ করা একটা মেয়েকেও বাসায় হোম অ্যাটেন্ডেন্স হিসেবে রেখে দিয়েছেন মাহবুবের মা।
সম্পদশালী বাবার ছোট ছেলে মাহবুব ছোটবেলা থেকেই বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত। তাই সম্পত্তির উত্তরাধিকার হারানোর ভয়ে নুসরাতকে বিয়ে করতে রাজি হওয়া ছাড়া মাহবুবের অন্য কোনো উপায়ও ছিল না। কিন্তু সেই সাথে তার নিজের একটা পরিকল্পনাও ছিল বটে। বিয়ে করার সময়ই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, নুসরাতকে সে বিয়ে করবে ঠিকই কিন্তু তাকে বউ হিসেবে কোনো অধিকার দিবে না। উপরন্তু সে তার সাথে এমন দুর্ব্যবহার করবে যাতে নুসরাত একসময় বাধ্য হয়ে নিজে থেকেই মাহবুবকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়। বিয়ের সাত মাস ইতোমধ্যে অতিবাহিত কিন্তু এখনও নুসরাত তার সাথেই আছে। মেয়েটার সহ্য ক্ষমতার প্রশংসা সে না করে পারেও না। সকল অত্যাচার, অনাচার সহ্য করে মেয়েটা বেশ টিকে আছে এতদিন। তবে সে প্রায় নিশ্চিত, আর কিছুদিন পরেই নুসরাত তার সহ্যের শেষ সীমানায় পৌছে যাবে। মাহবুব সেই সময়টার অপেক্ষা করছে খুব আগ্রহ নিয়ে।
পোশাকবিহীন মাহবুব নব ঘুরিযে সজোরে ধাক্কা দিতেই নুসরাতের রুমের দরজা খুলে গেল। নবটি ছেড়ে দেয়ার কারণে দরজাটি বেশ দ্রুতবেগে গিয়ে দেয়ালের সাথে লাগতেই দড়াম করে একটা শব্দ হলো। এতো জোরে শব্দ হলেও নুসরাতের ঘুম ভাঙলো না। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন নুসরাতের বিছানার কাছে দাঁড়াতেই মাহবুবের মুখ জুড়ে রক্ত হিম করা হাসি ছড়িয়ে পড়লো। নুসরাত এখনও নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। অবিন্যস্ত চুলগুলো তার অদ্ভুত গড়ন মুখাবয়বের এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে। মাহবুব নুসারতের সেই ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়েই চরম বিতৃষ্ণায় নাক সিঁটকালো। তবু প্রতি শনি ও বৃহষ্পতিবার রাতে নুসরাতের রুমে আসা মাহবুবের পরিকল্পনারই একটা অংশ। শনি ও বৃহষ্পতিবারের এই ব্যাপারটা নুসরাত এতদিনেও বুঝতে পারেনি বলে আবারো বুকের গভীর থেকে এক রাশ ঘৃণা বের হয়ে এলো এক দলা থুতুর সাথে সাথে। মেয়েদের বুদ্ধি এতো খাটো হয় কী করে তাই সে বুঝে না। সিনেমায় যাদের সাথে কাজ করে- ঝুমাদি, ঝর্ণাদি, হ্যাপি আপা, পুনম, শর্মিলি, তুলি- তারা কতটা অকপট সুন্দর ও মেধাবী। তুলির কথা মনে হলেই তার হার্টবিট বেড়ে যায় মুহূর্তে। ভেবে রেখেছিল তুলিকেই সে বিয়ে করে জীবনসঙ্গী করবে। বাঙালি মেয়েরাও যে এত স্মার্ট হতে পারে- এটা তুলিকে না দেখলে জানতে পারতো না কখনো। যতবার তার সাথে ডেটিংএ গিয়েছিল ততবারই তার সাবলীলতায় মুগ্ধ হয়েছিল মাহবুব। তাছাড়া নাটকে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করে বলে তার মেয়েভক্তদের সংখ্যাও প্রচুর। ভক্তদের অনেককে নিয়েই সে তার বাবার রিসোর্টে বাবার অগোচরে কর্মচারীদের খুশি করার মাধ্যমে মুখ বন্ধ রেখে মাঝেমধ্যে এসেছে। তাদের কাউকেই তো নুসরাতের মতো এতটা নিরস ও এতটা নির্বোধ বলে মনে হয়নি কখনো। ভাবতে ভাবতেই সে বিছানার চাদরের কিনারা দুমুঠোতে নিয়ে তা সজোরে টান দিলো। হেচকা টানে চাদরটি নুসরাতের নিচ থেকে পুরোটা বের হয়ে না এলেও প্রবল ঝাঁকুনিতে নুসরাতের ঘুম ভাঙাতে সক্ষম হল। ভীত সন্ত্রস্ত নুসরাতের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কেটে গেল মুহূর্তে। হালকা নীলাভ আলোয় দৈত্যসম শরীরটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে সে চিৎকার করে উঠলো। আশু যন্ত্রণাদায়ক মুহূর্তগুলোর কথা ভেবে নিথর হয়ে গেল তার সারাটা শরীর। গলা দিয়ে কোনোরকমে বের হল- এখানে কী করছেন আপনি?
-চুপ! আমি কি তোমাকে কথা বলতে বলেছি? তুমি জানো না প্রতি শনি ও বৃহস্পতিবার রাতে আমি কেন আসি? গরু একটা!
বলেই সে বিছানায় ওঠে বাঘের মতো ঝাপিয়ে পড়লো নুসরাতের উপর।
নুসরাতের কণ্ঠে:
মাহবুব কতক্ষণ এখানে ছিল জানি না। আসলে ঐ মুহূর্তটায় আমি আমার সকল বোধশক্তি হারিয়ে ফেলি। মাহবুব বলছিল প্রতি শনি ও বৃহস্পতিবার সে যে আমার রুমে আসে আমি এটা জানি না। মাহবুবের ধারণাটা আসলে ভুল। আমি বেশ ভালো করে জানি সপ্তাহের এ দুটো রাত সে আমার রুমে আসবেই। ব্যাপারটা সূর্যের আলোর মতোই স্পষ্ট হবার পরেও এ ব্যাপারে আমি কিছুই করতে পারি না। অত্যাধুনিক এই বাড়িটা আমার জন্য একটা টর্চার সেল বিয়ের প্রথম রাত থেকেই। কতবার যে আমি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি এখান থেকে। কতবার যে আমি চেয়েছি এই মাহবুব তরফদারের মুখটি যেন আমাকে আর দেখতে না হয়। কিন্তু আমি পালিয়ে যেতে পারিনি। পারিনি মূলত: দুটি কারণে-
প্রথম কারণটি হলো মাহবুবের মা। তার মতো মমতাময় মহিলা আমি কখনো দেখিনি। আমাদের পরিবারের বেহাল অর্থনৈতিক অবস্থা জানার পরেও তিনি একবারও তার ভ্রু কুঁচকালেন না। বরং আমি যে এমন কঠিন অবস্থাতে থেকেও এইচএসসিতে এ প্লাস পেয়েছি, অ্যাকাউন্টিং অনার্সে ভর্তি হয়েছি এটার বেশ প্রশংসা করলেন। আমাকে বুকে টেনে নিলেন। ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে এই প্রথম আমি কোনো মায়ের মমতা বুঝতে পেরেছিলাম। তার কোনো মেয়ে নাই বলে তিনি আমাকে তার মেয়ের চোখেই দেখবেন বলে প্রতিজ্ঞা করলেন। আমার দেখাশোনার জন্য তিনি নিজে তৎপর হয়ে বিশ হাজার টাকা বেতনে একজন হোম অ্যাটেন্ডেন্সও রেখে দিলেন। তার এত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিদিন একবেলা এসে আমাকে দেখে যান। আমি চলে গেলে জানি তিনি খুব কষ্ট পাবেন। মায়ের মতো মমতাময়ী এ মানুষটাকে মা-হারা আমি কেন জানি না কষ্ট দিতে পারি না।
দ্বিতীয় কারণটি হলো দারিদ্র। বাবার খুব বেশি দূর পড়াশোনা না থাকায় একটা দোকানে সেলসম্যানের কাজ করে পরিবারের খরচ মেটানোটা তার কাছে খুব কষ্টকর হয়ে পড়ছিল। তার উপর আমিসহ আমার বাকি দুইবোনের পড়াশোনার খরচ চালানো রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল একসময়। আমার ছোট দুইবোন আমার চেয়েও মেধাবী। আমার এ বাড়িতে আসায় তাদের একটা উপায় হয়েছে। আমার বিয়েতে বাবা এককালীন অনেক টাকা পেয়েছেন মাহবুবের বাবার কাছ থেকে। শুনেছি, সেই টাকায় তারা আগের ছোট্ট বহু পুরাতন ভূতুড়ে সেই বাসা ছেড়ে দিয়ে আরেকটা ভালো বাসায় উঠেছেন। শুধু তাই না। মাহবুবের বাবার চেষ্টায় বাবা একটা চা বাগানেও চাকরি পেয়েছেন। আমার ছোট দুটো বোন এখন অনেক আনন্দে আছে, সুখে আছে। পড়াশোনাও করতে পারছে ঠিকঠাকমতো। মা না থাকায়, তাদের কাছে আমি নিজেই তো মা-স্বরূপ। আমি জানি, আমি পালিয়ে গেলে বাবাকে তার টাকাগুলো ফেরত দিতে হবে। আমাদের আবার সেই টানাপোড়েনের সংসারে ফিরে যেতে হবে। তাই এখান থেকে পালানোর চিন্তা করলেও শেষমেষ পারি না পালাতে। আদুরিকে বললেই এখান থেকে পালানোর সব ব্যবস্থা সে করে দিবে। কিন্তু আমি পারি না। কোথা থেকে জানি এক রাশ ভয় এসে গ্রাস করে আমার দেহ ও মন। আমি পারি না পালাতে। এই টর্চার সেলটাই আমার জীবনের ভবিতব্য ভেবে সয়ে যাচ্ছি সব কিছু।
এ রাজ্যটি যেন এক অত্যাচারী রাজার অধীন। সেই অত্যাচারী রাজা আমাকে অত্যাচারের পাশাপাশি বিদ্রুপ করার ন্যূনতম সুযোগটাও হাতছাড়া করে না কখনো। গত রাতে ডিনার করার সময় তার চোখে চোখ পড়েছিল হঠাৎ করে। এর শাস্তিস্বরূপ সে আমাকে ভাতের প্লেটটা নিয়ে মেঝেতে বসে খেতে বলে। তার কোনো আদেশ অমান্য করার সাহস আমার নাই। অতীতে এর অনেক প্রমাণ পেয়েছি, অমান্য করা মাত্রই ভয়াবহভাবে হাত তোলে সে আমার উপর। আমি ভয়ে ভয়ে মেঝেতে বসেই খাবার শেষ করি।
তার চোখে চোখ রেখে কথা না বলার নিয়ম সে জারি করেছিল বিয়ের প্রথম রাতেই। আমার জন্য আরেকটা বিশেষ নিয়ম বেঁধে দেয়া আছে মাহবুবের । আমি তাকে কখনো নাম ধরে ডাকতে পারবো না। আপনি করে সম্বোধন করতে হবে সবসময়।
ও, হ্যা। আরেকটা নির্দেশনা আছে আমার জন্য। বাইরের মানুষের সামনে আমাকে সবসময় স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে। মাহবুবের সাথে আমার সত্যিকারের সম্পর্কের কথা যেন বাইরের কেউ না জানে। এমনকি মাহবুবের বাব-মাও যেন কখনো টের না পান এ ঘটনা। তাই তাদের সামনে অতি অবশ্যই স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে।
সকাল হয়ে গেছে বোধহয়। বিছানা থেকে নামতে হবে। এমন সময় আবারো মাহবুব আমার রুমে এল। আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলাম।
-মা নাকি আমাদের সাথে নাস্তা করবে। নিজেকে ঠিকঠাক করে নাও তাড়াতাড়ি। আর খবরদার। মা যদি এসবের কিছু জানে তাহলে কিন্তু আমি তোমাকে জানে মেরে ফেলবো বললাম।
যেভাবে অতর্কিতে এসেছিল সেভাবেই উল্কার বেগে সে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
নাহ! আর হবে না। আর পারবো না আমি। যা হবার তাই হবে। মেরে ফেলুক এই পাষন্ডটা আমাকে। মরে গেলেই শান্তি। তবুও মাকে আমি আজ সবকিছু বলবোই। বলে দিব তাকে, তার ছোট ছেলে আমার সাথে কতোটা অন্যায় করছে। সবকিছু শুনে কী করবেন তিনি? মাহবুবকে বঞ্চিত করবেন তাদের উত্তরাধিকার থেকে? নাকি তিনি এসব কিছু আগে থেকেই জানতেন? তিনি কি তখন আমার উপর রেগে যাবেন? মায়ের চরিত্র থেকে তিনি কি তখন ডাইনীতে রূপান্তরিত হবেন? ভুলে যাবেন কি তার জন্য আমার বিশেষ সেই আত্মত্যাগের কথা? (চলবে)

সিজন-১, পর্ব # ২

নুসরাতের কণ্ঠে: 

গোসল সেরে শরীর শুকিয়ে একটা হলুদ রঙের ফুল স্লিভ মেক্সি পরে নিলাম আমার পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চি শরীরটাকে ভালোমতো ঢেকে দেয়ার জন্য। আমি চাই না আমার শরীরের কোনো আঘাতের চিহ্ন মাহবুবের মায়ের চোখে পড়ুক। ডাইনিং রুমে ঢুকে দশ-চেয়ারের ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসে পড়লাম চুপচাপ। প্রাণপণ চেষ্টা করছি চোখের দৃষ্টি যেন সোনালী রঙের কাঠের টেবিলের উপরেই আবদ্ধ থাকে। এই ডাইনিং টেবিলটার উপরে ঝুলানো ঝাড়বাতিটি আমার খুব ভালো লাগে। স্যুইচ টিপলেই তা রংধনু আলোয় জ্বলে উঠে আবার নিভে যায়। তারপর আবার জ্বলে। জোনাক পোকার মতো তার জ্বলা আর নিভে যাওয়া দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও উপরের দিকে তাকাচ্ছি না। যদি দুর্ঘটনাবশত মাহবুবের চোখে চোখ পড়ে যায় তাহলে নির্ঘাত তার সামনে রাখা গ্লাসের পানি আমার মুখে ছুঁড়ে মারবে। আমি সে সুযোগ কখনোই তাকে দিতে পারি না। 

মাহবুবের দিকে না তাকিয়েই অনুভব করতে পারছিলাম সে তার দৃষ্টির আগুণে আমাকে ভস্ম করে ফেলতে চাইছে। তার চোখ থেকে বিকিরিত হওয়া সেই উত্তাপ যেন আমার গায়ে এসে লাগছিল। আমি ঘামতে শুরু করলাম। কেউ যদি এখন ফ্রিজের উপরে রাখা রিমোট কন্ট্রোলটা দিয়ে এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে দিত! মাহবুবের সামনে এলেই আমার গরম লাগতে শুরু করে, পা দুটোও যেন অসার হয়ে যায়। -এত কিছু থাকতে হলুদ রঙটাই পরলে? জানো না, হলুদে তোমাকে আরো কালো লাগে? আমার গায়ের রঙ মোটেও কালো না। উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের কাউকে কালো বলতে পারে না কেউ। তাছাড়া গায়ের রঙে কিইবা যায় আসে? কথাগুলো বলতে গিয়েও সাহস হলো না। -চুপ করে আছো কেন? কথা কানে যায় না তোমার? বলেই মাহবুব তার হাত দিয়ে খুব জোরে টেবিলে চাপড় মারলো। ভয়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। -আপনি কি চান আমি অন্য কোনো রঙের পোশাক পরে আসি? রুমের ভেতর কিছুক্ষণ পিন-পতন নীরবতা বিরাজ করলো। মাহবুবের ভয়ে দেয়াল ঘড়িটাও বোধ করি তার টিক টিক করা থামিয়ে দিয়েছে। মাহবুব কী করবে এখন? গ্লাস ভরা পানি ছুড়ে মারবে আমার দিকে? নাকি আমাকে এসে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেবে? না, এখন সে এমনটা করবে না। একটু পর তার মা আসবেন। এই সময় আমাকে আঘাত করার মতো বোকা সে নয়। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আমি শুনতে পেলাম মাহবুবের কণ্ঠস্বর। -না, কী লাভ? তুমি যা-ই পড়বে তাতেই তোমাকে কুৎসিত দেখাবে। কবির: কবির কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না কিছুক্ষণ আগে যে জল ছিল শান্ত স্থবির, যে জল ছিল স্বচ্ছ নীল রঙের, সে জলে হঠাৎ করে এত বিশালাকার ঢেউ তৈরি হলো কী করে। উন্মত্ত সেই ঢেউটি তাকে গিলে ফেলতেই যেন ধেয়ে আসছে বিপুল বেগে। ডেনজার জোন ছেড়ে সে তাড়াতাড়ি পাড়ের দিকে সাঁতার কাটতে থাকলো। তিনদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা পুলটা থেকে বের হতে গেলে যেদিক থেকে ঢেউটি ধেয়ে আসছে সেদিকেই এগুতে হাবে তাকে। ঢেউয়ের সাথে সংঘর্ষ তার অনিবার্য। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না এত শক্তিশালী, এত উঁচু একটা ঢেউ পেরিয়ে সে কীভাবে ওপাশে যাবে। পুলের ওপাশে গভীরতা কম। বড় ঢেউয়ের আগেই আছে ছোট ছোট অসংখ্য ঢেউ। সেই ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে বড় ঢেউটার অন্য পাশে সে দেখতে পেলো কোথা থেকে জানি এক দল ছেলেমেয়ে এসে ঢেউয়ের তালে তালে ভাসছে, দুলছে আর অট্টহাস্য করছে। এপাশে আতংকিত কবির দেখতে পেল ওপাশের কেউই পুলের মধ্যরেখা অতিক্রম করছে না। সে বুঝতে পারলো একটু আগে স্যুইমিং পুলের নির্জন শান্ত-স্থির জলরাশি দেখে সে যেখানে নেমেছিল সেটা আসলে সাধারণ কোনো স্যুইমিং পুল না, সেটা অন্য আর সাত-আটটা রাইডের মতোই একটা রাইড যা নির্দিষ্ট কোনো সময়ে চালু করা হয়। কবির ঢাকা এসেছিল দোলনের অনুরোধে। দোলন কবিরের বন্ধু। একটা ব্যাংকে চাকরি করে সে। বৃহস্পতি আর শনি- দুদিনের জরুরি ট্রেনিংয়ে দোলনকে ঢাকা আসতে হয়েছে। মাঝের শুক্রবারের পুরো একটা দিন একা থাকতে পারবে না বলে কবিরকে সে ঢাকা নিয়ে এসেছে। ফ্যান্টাসি কিংডমে বেড়াতে আসার ইচ্ছে কবিরের একেবারেই ছিল না। তার ইচ্ছে ছিল দাবা ফেডারেশনে গিয়ে দাবা খেলবে। কিন্তু দোলনের চাপাচাপিতে ফ্যান্টাসিতে আসতেই হয়েছে শেষ পর্যন্ত। ফ্যান্টাসি কিংডমের অন্যতম আকর্ষণ ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের কথা আগেই জেনেছিল তারা। তাই এখানে এসেই তারা ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের টিকেট কেটেছে। সাঁতার জানলেও জলের প্রতি আলাদা কোনো আগ্রহ কখনোই বোধ করেনি কবির। তাই দোলন যখন অন্যান্য ভিজিটরদের সাথে বিভিন্ন রাইডে মজা করছিল, কবির বসন্ত বিকেলের নরম রোদে রাইডগুলির পাশে পাশে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে একসময় এই স্যুইমিং পুলটা তার চোখে পড়লো। আশেপাশে আর কারো উপস্থিতি নাই দেখে কবিরের হঠাৎ করে সাধ জেগে উঠলো সাঁতার কাটার। ক’বছর আগে ছাত্রাবস্থায় সে নিয়মিত সাঁতার কাটতো। সাঁতারকে সে নিয়েছিল ব্যায়াম হিসেবে। ইউনিভার্সিটি কলেজ বার্মিংহামে কুলিনারি আর্টস মেনেজমেন্ট পড়ার সময় সে প্রতিদিন নিয়ম করে আধাঘন্টা সাঁতার কাটতো। দেশে ফেরার পরে সে সাঁতার বাদ দিয়ে প্রতিদিন ভোরে এক ঘন্টা করে দৌড়ায়। ভালো রান্না করতে হলে মানসিক ফিটনেসের সাথে সাথে শারীরিক ফিটনেসটাও যে খুব জরুরি। দীর্ঘদিন পর হঠাৎ সাঁতার কাটার ইচ্ছে হওয়াতে পাশের স্টোর থেকে একটা স্যুইমিং কস্টিউম ভাড়া নিয়ে সেটা পরে জলে নেমে গিয়েছিল। নেমেই বুঝতে পারলো পুলটা আসলে সাঁতারের জন্য তৈরি করা হয়নি। শুরুর অর্ধেক জুড়ে গভীরতা একবারেই কম। মাঝখানে গিয়ে সে দেখতে পেল জল তার হাঁটু স্পর্শ করছে। হাঁটতে হাঁটতে সে এগুতে থাকলো। একেবারে শেষ মাথায় এসে সে গলা সমান জল পেলো। এদিকের দেয়ালে জলের একটুখানি উপরে আবার ড্যানজার সাইন দিয়ে একটা নোটিশ ঝুলানো আছে। তাতে লেখা- গভীর অঞ্চল। যেখানে দাঁড়ালে নিজের গলা পর্যন্ত ডুবানো যায়ে সেখানটাকে বলা হচ্ছে গভীর অঞ্চল! এটা কীরকম রসিকতা ঠিক বুঝতে পারলো না কবির। যাই হোক, একটুখানি গভীরতা পেয়ে সে আপন মনে যখন সাঁতার কাটা শুরু করলো তখনই দেখতে পেল অতর্কিতে কোথা থেকে জানি অসংখ্য ছোট ছোট ঢেউ জেগে উঠেছে। আর সেই ঢেউয়ের পেছনেই দানবীয় একটা ঢেউ তার দিকেই ধেয়ে আসছে প্রবল গতিবেগে। পাড়ে ফিরে যেতে হলে তাকে সেই ঢেউ মোকাবেলা করে এগোতে হবে। শরীরে যথেষ্ট শক্তি রাখে সে। একসাথে পাঁচ-ছয় জনকে ধরাশায়ী করার সামর্থ্য তার আছে, সে জানে। কিন্তু কখনো জলের সাথে যুদ্ধ করা হয়ে ওঠেনি। তাই সে বুঝতে পারছে না আসলেই কি ঢেউ অতিক্রম করে পাড়ে পৌঁছাতে পারবে ? ভাবতে ভাবতে দৈত্যস্বরূপ সেই ঢেউটি এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে কয়েক ইঞ্চি পিছিয়ে দিলো। মুহূর্তের জন্য সে তলিয়ে গেল পানির নিচে। ভাগ্যিস আগেই দম আটকে ফেলেছিল। ভেসে উঠার আগ পর্যন্ত আর নিঃশ্বাস নেয়ার উপায় ছিল না তার। ঢেউটি ফিরে গেলে ভেসে উঠে মুখ হা করে জোরে এক দলা বাতাস শ্বাসনালীতে চালান করে দিলো সে। রাইড শুরু হতেই যারা যারা দৌড়ে এসে পুলে নেমেছিল তারা সেই হাঁটুপানিতেই ঢেউয়ে ভেসে থাকার খেলা খেলছে গভীর আনন্দে হৈ হুল্লোড় করতে করতে। হায় কপাল! চলে যাওয়া ঢেউটি মুহূর্তের মধ্যে আবার ফিরে আসছে! এবার যেন দ্বিগুন গতিবেগে। তাড়াতাড়ি মুখ খুলে অনেকখানি বাতাস মুখের ভেতর নিয়ে দম আটকে রাখলো। কবিরের গোটা দেহ মাথাসমেত পানিতে তলিয়ে গেল আবার। আতংক যেন বেড়ে গেল আরো কয়েকগুণ। সে বুঝতে পারলো না এ রাইডটি কতক্ষণ চলবে। ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কতক্ষণ টিতে থাকতে হবে তাকে। ঢেউয়ের প্রচণ্ড শক্তি উপলদ্ধি করে এটা বুঝে নিল যে, এ ঢেউ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সে কিছুতেই পাড়ে পৌছাতে পারবে না। বড় ঢেউটা ফিরে গেলে সে চিৎকার করতে চাইলো। কিন্তু কোথা থেকে জানি তার মনে একরাশ লজ্জা এসে ভর করলো। তার মনে হলো, যেখানে সবাই মজা করতে এসেছে সেখানে তার মতো বত্রিশ বছর বয়সের বুড়ো ধাম পানিতে ডুবে মরছে- এটা জানলে সবাই হাসাহাসি করবে? তাই সে সিদ্ধান্ত নিল ঢেউয়ের সাথে একা একা চুপচাপ যুদ্ধই করবে। আবারো ঢেউ! সমুদ্রের ঢেউওতো এত ভয়ংকর মনে হয় নি তার কাছে কখনো। আসলে সময় এবং অবস্থায় একটা তেলাপোকাকেও ভয়ংকর কোনো প্রাণী বলে মনে হতে পারে। সে তাড়াতাড়ি ফুসফুসে বাতাস নিয়ে দম বন্ধ করে পানিতে তলিয়ে গেল। যে করেই হোক তাকে কিছুক্ষণ টিকে থাকতে হবে। অন্যান্য রাইডগুলি দেখে সে বুঝেছে এটি কম করে হলেও আধঘন্টা চলবে। মধুর সময়ে আধ ঘন্টা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু কঠিন মুহূর্তের পাঁচ মিনিটকেও পাঁচ বছর সমান মনে হয়। তার মনে পড়ে ছোটবেলায় পরীক্ষার পর ক্রিকেট খেলার সেই শীতকালটা কত তাড়াতাড়িই না চলে যেত। অথচ ফাইনাল পরীক্ষার আগের দিনগুলো যেন যেতেই চাইতো না। ঢেউ ফিরে গেলে সে নিজেকে আবিস্কার করল পুলটির দেয়ালে তার পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থায়। এদিকের দেয়ালটা অনেক উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। উপরে দেখা গেল দুজন সিকিউরিটি গার্ড একসাথে দাঁড়িয়ে খোসগল্পে মত্ত রয়েছে। দূরে কোথাও কোনো মিউজিক সেন্টার রাখা আছে তা থেকে হিন্দি ছবির ঝাকানাকা গান ভেসে আসছে। কবির বুঝে গেছে গান আর রাইডে হৈ-হুল্লোড়রতদের চিৎকারে তার জীবন বাঁচানোর আর্তচিৎকার কেউ শুনতে পাবে না। যা করার তাকে একাই করতে হবে। যেহেতু দেয়ালে তার পিঠ ঠেকে গেছে আর পানির নিচে পা-দুটো একটু পেছনে নিলেই দেয়ালের স্পর্শ পাচ্ছে, তাই সে ঠিক করলো নিচে পা দিয়ে দেয়ালে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সামনের বুক সমান পানি পর্যন্ত এগিয়ে যাবে। এই ভেবে সে পা দুটো দিয়ে একসাথে সজোরে দেয়ালে ধাক্কা দিল। ধাক্কা দিয়েই বুঝতে পারলো মস্ত বড়ো ভুল করে ফেলেছে সে। তার পা দুটো আটকে গেছে। পানির নিচে দেয়ালে একটা বড় ছিদ্র আছে তাতে রড দিয়ে দরজামতো কিছু একটা আছে। কৃত্রিম ঢেউটা সম্ভবত এখান থেকেই সৃষ্টি করা হয়। তার দুই পা সেই ভয়াবহ ছিদ্রের ভেতর ঢুকে আটকে গেছে। তখনই আরেকটা ঢেউ এসে তাকে ডুবিয়ে দিলো পানিতে। টেনশনে মুখভরা বাতাস নিতে ভুলে গিয়েছিল এবার। তাই দম বন্ধ রাখতে খুব সমস্যা হচ্ছে। সামনে নিশ্চিত মৃত্যু। বুজে রাখা চোখের সামনে তার প্রিয় খবরের কাগজটির প্রথম পাতা ভেসে উঠলো। তাতে বড় বড় করে লেখা- ফ্যান্টাসি কিংডমে বেড়াতে এসে ত্রিশোর্ধ যুবকের মৃত্যু। তারপর ভেসে এলো তার মায়ের মুখ। মমতাময়ী মা তার একমাত্র ছেলের মৃত্যুশোক সামাল দিবেন কী করে? সে বরাবরই চেয়েছে তার মায়ের আগে যেন কোনোভাবেই তার মৃত্যু না ঘটে। সে মায়ের আগে মারা গেলে একা এই পৃথিবীতে তিনি কী করবেন, কীভাবে থাকবেন? মা কি সে কষ্ট সহ্য করতে পারবেন? সে নিজে সকল কষ্ট সহ্য করবে। কিন্তু মাকে কখনোই কোনো কষ্ট দিতে পারবে না। মা তাকে যতটা ভালোবাসেন, এ জগতে আর কেউ কি তাকে ততটা ভালোবাসে? সে ভেবেছিল কেউ একজন আছে যে তাকে ভালোবাসে। সে ভেবেছিল লুনা তাকে তার মায়ের থেকেও বেশি ভালোবাসে। লুনার কথা মনে হতেই সে তার সামনে জলজ্যান্ত একটা মৎস্যকুমারি দেখতে পেলো। মুখটা হুবহু লুনার মতো। পেছনে পায়ের বদলে মাছের মতো লেজ। বেণিবাঁধা লম্বা চুল আর ডাগর চোখের লুনা কোথা থেকে মাছেদের মতো সাঁতার কেটে কেটে তার সামনে এসে ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলে নিচে আটকে যাওয়া পা দুটোকে নাড়াচাড়া করিয়ে বন্দী অবস্থা থেকে সেগুলোকে মুক্ত করে তাকে ভাসিয়ে দিয়ে পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে কিছুদূর এগিয়ে দিলো। সম্বিত ফিরে পেয়ে কবির তার দুটো হাত আকাশের দিকে তুলে এদিক-ওদিক নাড়াতে থাকলো। তার সেই ভয়ার্ত হাত দেখে দুটি ছেলে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে এসে কবিরকে টেনে সামনের দিকে নিয়ে গেল। হাঁটু পানিতে এসে সে তার হারোনো শক্তি ফিরে পেল। ছেলে দুটো তাকে ছেড়ে দিয়ে কোথায় জানি হারিয়ে গেল। ঠিক তখনই দোলনকে দেখতে পেয়ে তাকে টেনে পাড়ে নিয়ে বললো, আর এক মুহূর্তও আমি এখানে থাকবো না। হোটেলে চলো। (চলবে)





সিজন- ১, পর্ব- ৩

কবির
উপরে নীল আকাশ, মাঝে মাঝে শিমুলতুলোর মতো শুভ্রশাদা মেঘের উড়োউড়ি, চোখ ফেরালেই বর্ণীল যতো পাখির ডানা ঝাপটানো, নিচে ছোটো ছোটো পাহাড়, পাহাড়ের কোলে বিস্তৃত সবুজ চাবাগান, যেন দৃষ্টির সীমানা অবধি সবুজের গালিচা বিছানো, গালিচায় ঝুলি কাঁধে কৃষ্ণাভ চা-কন্যাদের ইতস্তত হাঁটাহাঁটি! আনারস, লেবু আর সারি সারি রাবার বাগান, ঘন বন, বনের গহীন থেকে ভেসে আসা হিংস্র প্রাণীর রোমাঞ্চ জাগানিয়া ডাক, খনিজ গ্যাসকূপ, হ্রদ, হাওরের শান্ত জলরাশি, জলপ্রপাত, জলপতনের বিরামহীন শব্দ- প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এমন একটা জায়গা- শ্রীমঙ্গলে চাকরি করা নেহাৎ ভাগ্য ছাড়া আর কী হতে পারে?

রায়হান তরফদারের তিনটা রিসোর্টের খাবারের ব্যবস্থা করার সকল দায়িত্ব কবিরের হাতে। ছয় মাস সময়ের মধ্যেই সে তার রন্ধনশৈলী ও সততা দিয়ে রায়হান তরফদার ও তার সহধর্মীনির বেশ কাছের মানুষ এখন। রায়হান তরফদারের স্ত্রী রহিমা আক্তার তাকে রীতিমতো মায়ের মতোই স্নেহ করেন। তাদের বাড়িতে প্রায়ই রান্না করার ডাক পায় সে। মায়ের মমতায় দেখা মানুষটার জন্য নিজ হাতে রান্না করতে বেশ ভালো লাগে তার। রায়হান তরফদারের স্ত্রীকে প্রথম দিকে সে ম্যাডাম ডাকতো। কিছুদিন আগে তিনি নিজে থেকেই ম্যাডাম ডাকতে নিষেধ করে দিয়েছেন। বলেছেন, আমি তোমাকে আমার ছেলের মতোই দেখি। নিজের ছেলের মুখে ম্যাডাম ডাক কার ভালো লাগে বলো? তুমি মা ডাকতে না পারো, আন্টিতো ডাকতে পারো। এরপর থেকে কবির তাকে আন্টি ডাকে। আন্টির যে কোনো ডাকে সাড়া দিতে পারলে তার মন ভালো লাগায় ভরে যায়। তার জন্য রান্না করাটাকেও কবিরের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ বলে মনে হয়। খাবারের এতো নিপুণ সমঝদার সে খুব কম দেখেছে। যেনতেন ভাবে রান্না করে তাকে বিমোহিত করা মোটেও সম্ভব না। এ জন্যই তার জন্য কিছু রাঁধতে গেলে সে বেশ থ্রিল অনুভব করে। তার পাতে খাবার তুলে দেয়ার পর থেকে তিনি তা মুখে নেয়ার সময় পর্যন্ত তার হার্টবিট বেড়ে যায় নিজের অজান্তেই। কিছুতেই সে স্বাভাবিক থাকতে পারে না। ছেলেবেলায় প্রথম খেলা ক্রিকেট ফাইনালের কথা মনে পড়ে যায় তার। ম্যাচ টেম্পারমেন্ট না থাকায় ঐ ম্যাচের শুরু থেকেই তার বুক যেভাবে ঢিপঢিপ করা শুরু করেছিল, আন্টির জন্য খাবার রান্নার পর থেকে তার খাবার মুখে দিয়ে মন্তব্য শুনার আগ পর্যন্ত প্রতিবার তার একই অনুভূতি হয়। আজ আন্টি তার ছোট ছেলের বাসায় কবিরকে নিয়ে এসেছেন। তার অনেক দিনের নাকি শখ ছোট ছেলে আর ছেলে বউকে তিনি কবিরের হাতের রান্না খাওয়াবেন। অনেক দিন থেকে আন্টি তাকে বলে আসছেন একদিন তার সাথে ছোট ছেলের বাংলোতে যেতে হবে। আজ সেই দিন। আজ কবির ঠিক করে রেখেছে তাদেরকে ব্যাম্বো চিকেন খাওয়াবে। এই রান্নাটা সে শিখেছিল গত বছর রাঙামাটি বেড়াতে গিয়ে। ব্যাম্বো চিকেন অর্থাৎ বাঁশের চোঙার ভেতর রান্না করা মুরগির মাংস পাহাড়ে খুবই জনপ্রিয়। শুধু মুরগি নয়, মাছ বা শুটকিও রান্না করা যায় এই চোঙার ভেতরে। চাকমারা একে চুমো গোরাং বলে আর মারমারা বলে ক্যাং দং হাং। এই রান্নাটার জন্য প্রয়োজন বাঁশ। কাঁচা বাঁশ হলে খুব ভালো হয়। কাঁচা বাঁশে পানির পরিমাণ বেশি থাকায় সহজে পুড়ে যায় না। দীর্ঘ সময় আগুণে রাখা যায়। মাংসের টুকরোগুলো যেন ছোট হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে বিশেষভাবে। রান্নার জন্য মাছ বা মাংস একটি পাত্রে রেখে তার মধ্যে পরিমাণমতো তেল, পানি, লবণ, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন, আদা দিয়ে ভালোভাবে মাখাতে হয়। বাঁশের চোঙার ভেতর মুরগির মাংস রান্নার এই পদ্ধতিতে পানি কিংবা তেল কোনোটাই ব্যবহার করা হয় না। চুলার এক প্রান্ত খোলা থাকে, কিছুক্ষণ পরে কলাপাতা মুড়ে বাঁশের মুখ বন্ধ করে দিতে হয়। এবার বাঁশটা কয়লার আগুণে পুড়লেই ব্যাম্বো চিকেন তৈরি হয়ে যায়। বাঁশটা পুড়ে কালো হয়ে গেলেই বুঝে নিতে হবে বাঁশের ভেতরের মাংস রান্না হয়ে গেছে। খেয়াল রাখতে হবে পুরো বাঁশের চোঙাটি যেন সবদিকে সমান তাপ পায়। ব্যাম্বো চিকেন রান্নার মুন্সিয়ানা আসলে এখানেই দেখাতে হয়। খুব সতর্কতার সাথে বাঁশটি চারদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিতে হয়। রান্না করার কৃতিত্ব আসলে তখনই যখন তা মানুষের মনে একটা মোহের সৃষ্টি করবে। পাতের নির্দিষ্ট খাবার শেষ করার পর আবার খেতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে খাবারের যোগান যেন আর তখন না থাকে। একবার দেখানো ম্যাজিক একই দর্শককে ঘুরে ফিরে কয়েকবার দেখালেই ম্যাজিকের রহস্যটি যেমন দর্শকের চোখে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায় তেমনি খাদককে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার দিয়ে দিলে সেই খাবারের স্বাদটা তার কাছে তখন সাধারণ হয়ে যায়। কবির আজ খুব মনোযোগ দিয়ে রেঁধেছে কারণ  আজকের এই রান্নার উপলক্ষ আন্টির ছোট ছেলে আর তার ছেলে বউ। কবির জানে আন্টি তার এই ছেলে বউকেও ভীষণ ভালোবাসেন। নিজের মেয়ের মতোই দেখেন। কোনো এক বিশেষ কারণে তার এই ছেলে বউয়ের জন্য তার আলাদা নজর। খাবার তৈরি শেষে টেবিলে তা পরিবেশন করে দিতেই আন্টি তাকেও তাদের সাথে বসে খাওয়ার অনুরোধ করলেন। চেয়ারে বসতে বসতেই উল্টোদিকের চেয়ারে বসা মেয়েটার দিকে চোখ পড়তেই কবিরের চোখদুটো স্থির হয়ে গেল। জুবুথুবু হয়ে বসা মেয়েটাকে যেন লুনার মতোই লাগছে। না, একে যেন সেই মৎস্যকুমারীর মতো লাগছে যে সেদিন তাকে মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছিল। মেয়েটির মুখাবয়বের সাথে আসলেই লুনার অনেক মিল লক্ষ্য করলো সে। শুধু গালের তিলটা ছাড়া মুখের গড়নে এত মিল দেখে সে অপলক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। এটা কীভাবে সম্ভব! কিছুক্ষণ পরেই সে তার ভুল বুঝতে পারলো। লুনার সাথে এ মেয়ের যে মিল সেটা হচ্ছে চুলে। এমন মসৃণ ঝরঝরে লম্বা চুল সে শুধু লুনার মাথাতেই দেখেছিল। এমন চুল দেখেই পাবলো নেরুদা লিখেছিলেন, তোমার চুলের বর্ণনা করে/ কাটিয়ে দিতে পারি তামাম জীবন। 

-কী হলো নুসরাত খাওয়া শুরু করো। দেখো এই ছেলে কেমন রাঁধতে জানে। 

আন্টির কথায় কবির বাস্তবে ফিরে এলো।  

নিজের রান্না নিজের কাছে ভালো লাগে না- ওস্তাদদের এই আপ্তবাক্য সবসময়েই কবিরের কাছে ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। নিজের রান্না তার সবসময়েই ভালো লাগে। ব্যাম্বো চিকেন রেঁধে আগেও সে অনেক খেয়েছে। কিন্তু আজকের রান্না তার কাছে অসাধারণ ঠেকছে। সে বেশ বুঝতে পারছে, অন্যান্যরাও নিঃশব্দে হাত চেটেপুটে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার রান্না করা খাবার খাচ্ছে। আসলেই অধুনা কবি মুজিব ইরম ঠিকই বলেছেন- জীবন রসনাময়, আর সব ফাঁকি। নিজেকে রন্ধনশিল্পি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে বলে মনে মনে স্রস্টার কাছে তার অফুরান কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো কবির। 

-শোনো মাহবুব। তুমি তো কাল এক সপ্তাহের জন্য শুটিংয়ে দিনাজপুর যাবে। কবিরকে বলেছি তোমার অবর্তমানে তোমার এ বাংলোটা যেন দিনে একবার এসে দেখে যায়। 

কবিরকে এর আগে আরো দুইবার বাবার রিসোর্টে দেখেছে। শুরু থেকেই কবিরকে তার কেমন যেন গেঁয়ো-টাইপ একটা মানুষ বলে মনে হয়েছে। হতে পারে কবির বয়সে মাহবুবের তিন চার বছরের বড়ো। তাই বলে একটা মানুষ আচার-আচরণে এতো আনস্মার্ট হয় কী করে সে ভেবে পায় না। সব দোষ আসলে তার ঐ বাবুর্চিগিরি পেশাটার। পড়াশোনা জানা একটা ছেলে কী করে বাবুর্চিগিরিকে পেশা হিসেবে নেয় তা আসলেই সে বুঝতে পারে না। তাই সে কিছুতেই কবিরকে তার বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব দিতে পারে না। 

-মা, বাড়ি দেখাশোনার জন্য কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে না। আদুরি তো আছেই। 

– ননস্যান্স! সামনের লনের ঘাস কে কাটবে শুনি? তুমি যখন সিনেমার নায়িকাদের সাথে বৃষ্টিতে নাচানাচি করতে থাকবে তখন তোমার বাসার পুলের পানি কে পরিস্কার করবে, মাহবুব? আদুরি এমনিতেই অনেক কাজ করে। সারাটা বাসা দেখাশোনা তো সেই করে। তার কাজ আর বাড়ানো ঠিক হবে না। 

তার পেশার প্রতি মায়ের এমন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখে মাহবুব মন খারাপ করে মাথা নিচু করে বললো, মা, তুমি জানো এসব করার জন্য বাগানে অনেক মানুষ আছে। তাদের বললেই এসে সব কাজ করে দিবে।

-কাজ করে দিবে, কিন্তু সেই কাজ দেখবেটা কে? আজকাল বাগানের শ্রমিকরাও ফাঁকিবাজ হয়ে গেছে। ঠিকমতো তদারকি না করলে কিছুই করতে চায় না।  

মাহবুব বসেছে নুসরাতের ঠিক পাশের চেয়ারে, প্রয়োজন হলে যাতে সে টেবিলের নিচে তার পা দিয়ে নুসরাতের পায়ে আঘাত করে বেফাঁস কোনো কথা আটকে দিতে পারে। 

-তা মামনি নুসরাত, দিনকাল কেমন কাটছে তোমার?

এই একটা প্রশ্ন ইতোমধ্যে মা তিনবার করে ফেলেছেন নুসরাতকে। মাহবুবের ভয় এখানেই। যদি নুসরাত উল্টাপাল্টা কিছু বলে দেয়!

-সবকিছুই ভালো যাচ্ছে, মা।

নুসরাতকে নিশ্চুপ দেখে মাহবুব নিজেই উত্তর দিলো। 

-আমি তো নুসরাতের সাথে কথা বলছি মাহবুব। নুসরাত?

নুসরাতকে নিশ্চুপ দেখে মাহবুব তার ডান পা অল্প একটু ডানে সরিয়ে নুসরাতের পায়ের পাতায় মৃদু একটা চাপ দিল যা নুসরাতকে বাস্তবে নিয়ে এলো। 

-সবকিছুই ভালো কাটছে, মা।

অবশেষে নুসরাত উত্তর দিলে মাহবুব হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। 

-তুমি শিউর?

মায়ের প্রশ্নে এবার মাহবুবের গলায় খাবার যেন আটকে গেল। সে খুক খুক করে কেশে উঠলো। কবির তাড়াতাড়ি এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। এক ঢোঁক পানি গিলে নিলে মাহবুবের কাশি থেমে গেল।   

-শোনো কবির। তুমি দিনে একবার এলেই হবে। আদুরি তো আছেই। নুসরাতও থাকবে। তুমি এসে শুধু লনের ঘাসগুলো ছাটিয়ে দিও। আর আদুরির যদি কিছু লাগে তাহলে কিনে দিও। 

প্রসঙ্গ পাল্টাতে মাহবুব মায়ের প্রস্তাবনা মেনে নিয়ে কৌশলে বিষয়টা থামিয়ে দিলো।

-আচ্ছা মাহবুব, তুমি যখন দিনাজপুর যাচ্ছো নুসরাতকে সাথে নিয়ে যাও। শুনেছি দিনাজপুর খুব সুন্দর একটা এলাকা।  সেও দেখে আসতে পারতো। নুসারাত, তুমি দিনাজপুর যেতে চাও না?

-নুসরাত তার অন্যান্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে মা। আর তাছাড়া সেও তোমার মতোই। আমার পেশা নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই। 

রহিমা আক্তার ভ্রু কুঁচকে মাহবুবের দিকে এক পলক তাকিয়েই নুসরাতের দিকে তাকালেন। তিনি খেয়াল করেছেন নুসরাত একবারও মাথা তুলেনি, একবারও কারো মুখের দিকে তাকায়নি। তিনি বুঝতে পারলেন না, মাহবুব কেন নুসরাতকে করা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। 

-তিনি ঠিকই বলেছেন মা। আর তাছাড়া গতকাল থেকে শরীরটাও খারাপ লাগছে। 

সতর্ক মাহবুব এবার বেশ জোরেই নুসরাতের পায়ে চাপ দিল। হঠাৎ এমন ব্যথা পেয়ে নুসরাত চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়লো। 

রহিমা বেগমের হাত থেকে চামচ টেবিলের উপর পড়ে গেল। অবাক হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো নুসরাত?

মাহবুবের দম বন্ধ হবার মতো অবস্থা হলো। এই পৃথিবীর আর কাউকে সে পরোয়া করে না। শুধু মাকেই তার যত ভয়। এত কঠিন মহিলা সে তার জীবনেও দেখেনি। চাইলেই মুহূর্তে যে কোনো ডিসিশন নিয়ে নিতে পারেন পূর্বাপর কিছু না ভেবেই। ছোটবেলার সেই ভয়াবহ শাস্তির কথা মনে পড়লে আজও তার গা দিয়ে ঘাম ঝরে পড়ে। রাতে মার কথামতো পড়তে বসেনি বলে সারাটা রাত তাকে বাইরেই দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। বাবা আর দাদা মিলে কত করে যে অনুরোধ করেছিলেন তাকে ভেতরে নিয়ে আসতে কিন্তু মা কারো কথা শুনেননি। পুরোটা রাত তাকে বাসার বাইরের বারান্দায় কাটাতে হয়েছিল। উফ! মাহবুব সেই রাতের কথা ভাবতেও ভয় পায়। এখন কী হবে নুসরাত যদি মাকে সব বলে দেয়। মাহবুব খুব ভালো করে জানে বাবা-মা  তার এই সিনেমায় যাওয়াটাকে পছন্দ করেননি। আর সেকারণেই তার প্রতি তাদের এত বিরাগ। তার বিয়ের সময়তো বাবা রীতিমতো তার সম্পত্তি থেকে মাহবুবকে বঞ্চিত করার ঘোষণা দিয়েই দিয়েছিলেন। নুসরাতকে বিয়ে করে কোনোরকম রক্ষা। নুসরাত কী করবে এখন? নুসরাত কী মাকে এবার সবকিছু খুলে বলে দেবে?