তাড়াহুড়োর ঠেলায় ভুল করে ট্রেনের ভুল কম্পার্টমেন্টে উঠে হাতে নেয়া লাগেজের ভারে কুঁজো হয়ে লোকজনের ভীড় ঠেলতে ঠেলতে মিনিট পাঁচেক
হাঁটার পরে বুক পকেটে রাখা টিকেটের গায়ে লেখা ঢাকার ঢ নং বগিতে প্রবেশ করে ডানদিকের দেয়ালে লাল অক্ষরে লেখা সি- ১২ সংখ্যাটি দেখতে পাওয়ার পরে লাগেজটাকে মাথার উপরের ‌র্যাকে রেখে সিটে বসার পরে পাশে তাকিয়ে যদি দেখেন সেখানে আপনার প্রিয় লেখক বসে আছেন তাহলে আপনাদের কেমন লাগবে জানি না, আমি কিন্তু সাথে সাথে এভারেস্ট জয়ের মতো পুলকিত হয়ে উঠলাম। হঠাৎ আনন্দের আতিশয্যে লেখকের পায়ে ধরে মাথা নুইয়ে কদমবুচি করে ফেললাম। অচেনা-অজানা লোকের কাছ থেকে এমন হঠাৎ আবেগের বর্ষণ দেখে লেখক সাহেব অবাক হলেন কি না বুঝতে পারলাম না। তিনি যেমন ছিলেন তেমনটাই বসে রইলেন। বিখ্যাত লেখক বলে হয়তো এরকম ঘটনায় তিনি অভ্যস্ত। এমন কতশত লোক তার পায়ের ধূলো নিয়ে হরহামেশা লেখালেখির জগতে প্রবেশ করছে তার কি কোনো ইয়ত্তা আছে!
শ্রীমঙ্গল থেকে সিলেটের ট্রেন জার্নি মোট দু’ঘন্টার। এই দীর্ঘ সময় লেখকের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা যাবে ভেবে ভীষণ আনন্দিত হলাম। সদ্য লেখালেখি শুরু করা একজন মানুষের কাছে রাকিব স্যারের মতো এতো বড় মাপের এক লেখকের সাক্ষাৎ পাওয়া চাট্টিখানি কথা না। শুনেছি অন্য বড় লেখকদের মতো রাকিব স্যার তেমন রাশভারি লোক না। সবার সাথে মিশতে পারেন খুব সহজেই। তাই আমি নিশ্চিত তার সাথের এই পরবর্তী দুই ঘন্টা আমার অনেক ভালো কাটবে।
কিন্তু মিনিট দশেক চলে গেল তার সাথে কথাই শুরু হলো না। হাতে ধরে রাখা বইয়ের দিকে তিনি তাকিয়ে আছেন অপলক দৃষ্টিতে। বুঝলাম, সাহস করে কথা শুরু করতে হবে আমাকেই।
-স্যার, ভালো আছেন?
-হুম।
-স্যার, আমি আপনার একজন ভক্ত। আপনার প্রায় সকল লেখাই পড়েছি আমি। সত্যি বলতে কি, আমি নিজেও টুকটাক লেখালেখি করি।
-তাই নাকি?
-জি।
স্যার আবার পড়ায় মনোনিবেশ করেছেন বুঝতে পেরে বললাম, স্যার, আপনার লেখা অনেক দিন পাচ্ছি না।
লেখক আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক তাকালেন। প্রশ্নটা তার পছন্দ হল কি না বুঝলাম না; তবে নিশ্চিত হলাম, তিনি এবার মুখ খুলবেন।
যা ভেবেছিলাম তাই হল। তিনি তার হাতের বইটি বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর র্যাকে রাখা কালো রঙের অ্যাটাচি বের করে তার ভেতর বইটি ঢুকিয়ে দিয়ে সিটে বসে আমার দিকে তাকালেন ।
-মাস দুয়েক আগে আপনার লেখা তুরুপের তাস উপন্যাসের পর আর কোনো লেখা চোখে পড়ে নি। প্রথম সকালেও নতুন কোনো লেখা পাইনি আর।
-বাহ! আপনি তো দেখে আমার লেখার খোঁজখবর বেশ ভালোই রাখেন!
-আমি আপনার লেখার এক কঠিন ভক্ত স্যার। বিশ্বাস না হয় আমার বাসায় আসবেন। আপনার সকল বই ও গল্প আমার বিছানার কাছের আলমারিতে রাখা। সময় পেলেই আপনার বই পড়ি। বারবার পড়ি। আপনার লেখার ধরণটা ধরার চেষ্টা করছি।
-ধরতে পারলেন?
-এখনও না। কেন লিখছেন না জানানো যাবে কি?
তিনি ভ্রæ কুঁচকে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বলে উঠলেন, শুনতে চান?
-জি।
-ঠিক আছে, বলছি।
তিনি আবার উঠে দাঁড়ালেন। কালো সেই অ্যাটাচি থেকে একটা টিফিন বক্স মতো কিছু একটা খুলে আনলেন। সিটে বসে ওটা খুললে বুঝলাম ওটা একটা পানের বাটা। এক খিলি পান মুখে গুঁজে নিয়ে শুরু করলেন তার না লেখার কারণ।
জানতে যখন চাচ্ছেন একেবারে গোড়া থেকেই বলি তাহলে। লেখালেখির জগতে আমার প্রবেশ আসলে চিঠি লেখা দিয়ে। রুমা নামের এক মেয়েকে ভালোবাসতাম। আমরা তখন একই কলেজে পড়ি। নানাভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হলাম তখনই সুযোগটা এলো। সে একদিন ভুল করে তার বাংলা বইটা কলেজে ফেলে চলে গেল। আর আমি ফেলে এলাম আমার ক্যাপটা। ক্যাপ নিতে ক্লাসে ফিরে গিয়েই রুমা যে টেবিলে বসা ছিল তার উপর একাকী বইটা পড়ে থাকতে দেখে এগিয় গেলাম। বইয়ের উপরে রুমার নাম দেখে আমার হাত পা কাঁপা শুরু হলো। বুকের হার্টবিট গেল বেড়ে। বইটা রুমার! যে বইটা রুমার হাতের স্পর্শ পেয়েছে এতোকাল, সেই বইটা এখন আমার হাতে। বইটা হাতে নিয়ে তার গন্ধ শুকে বুকের গভীরে নিতে চাইলাম। বইটায় যেন আসলেই রুমার গায়ের গন্ধ লেগে আছে। বাসায় পৌছে তো সারা রাত আমার ঘুম নাই। যে বাংলা বই জীবনেও হাতে নেই নি সেই বইটার প্রতিটা গল্প, কবিতা পড়া হয়ে গেল আমার এক রাতেই। ভোর বেলা মনে হলো, রুমা নিশ্চয়ই বইটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কলেজে গিয়ে তাই প্রথম কাজ হবে বইটা তার হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু হঠাৎ একটা বুদ্ধি এলো মাথায়। কাগজ কলম নিয়ে হৃদয়ের গভীর আবেগ ঢেলে দিয়ে রুমার কাছে একটা চিঠি লিখলাম। লিখতে লিখতে মনে হলো আমি যেন রবি ঠাকুর হয়ে উঠেছি। মনে হলো, আমি যেন নজরুলের মতো ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দুলানো মহান পুরুষ! দীর্ঘ পাঁচ পৃষ্ঠার লেখা ছিলো সেই চিঠিটা। আমার সকল আবেগ নিংড়ানো চিঠিটা পড়লে রুমা নিশ্চয়ই আমাকে ভালো না বেসে পারবে না । ক্লাশের সকলের মতো আমিও জানতাম রুমা খুব সাহিত্যপাগল একটা মেয়ে। খুব বই পড়া মানুষ সে। তাই আমার চিঠি নিশ্চয়ই তাকে মুগ্ধ করবে। পরদিন ক্লাসে যাওয়া মাত্রই রুমাকে খুঁজে বের করে বইটা তার হাতে দিয়ে সটকে পড়েছিলাম কলেজ থেকে। চিঠিটা পড়ার সময় তার দৃষ্টিসীমানায় থাকা আমার জন্য বেশ লজ্জাজনক একটা ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল তখন। যাই হোক, পরদিন বুক ঢিপঢিপ অবস্থায় কলেজে গেলাম। রুমা তখন তার আর সব সাধারণ দিনের মতোই প্রথম বেঞ্চে বসে বান্ধবীদের সাথে কথা বলছিল। আমার ধারণা অনুযায়ী সে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে না দেখে বেশ অবাক হলাম এবং রাগও হলো। রেগে গিয়ে হোক অথবা অদম্য কৌতুহল থেকেই হোক, আমি বুক ভরা অসীম সাহস নিয়ে রুমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে আমাকে দেখে হাসিতে ফেটে পড়লো। বললো, এই যে রাকিব। তুমি ওসব ছাইপাশ কী লিখেছো? যেদিন সত্যিকারের লেখক হতে পারবে সেদিন আমি নিজে থেকেই তোমার কাছে যাব।
লজ্জায়, অপমানে আমি সেদিন ক্লাস থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম।
স্যারকে বাঁধা দিয়ে এ পর্যায়ে বলে উঠলাম, আপনার দীর্ঘ দিন ধরে লেখালেখি না করার সাথে কি তবে রুমার সম্পর্ক আছে?
লেখক আমার কথায় যেন বিরক্ত হলেন। আহ! গল্পের মাঝে কথা বলবেন না তো। শুনেন। বলছি।
রুমার উপর রাগ করেই আমার লেখালেখিতে আসা। রুমাকে পাওয়ার জন্য যতটা না, তার থেকে বেশি, তার উপর রাগের কারণেই লেখালেখিতে আসা আমার। তো, এলে কী হবে। আমার বংশে তো কস্মিন কালেও কেউ লেখক ছিল না। ইনফ্যাক্ট, আমাদের পরিবারে পড়ালেখারও তেমন কোনো চল ছিল না। লেখালেখি যার রক্তের ভেতর নেই, যে এই কাজকে কখনো ভালোই বাসেনি, সে যদি হুট করে লেখালেখি শুরু করে, কিছু কী হবে? তাই আমার লেখা কোথাও ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পেল না প্রথম দিকে। ও মনে পড়েছে, দাঁড়ান। এলাকার সাহিত্য পত্রিকায় মাঝে মাঝে দু-একটা গল্প ছাপানো হয়েছিল। তবে সেগুলো নিয়ে কোনো পাঠকের ভুয়সী কোনো প্রশংসা কখন্ইো শুনিনি। সাহস করে একবার নিজের টাকা দিয়ে একটা উপন্যাসও ছাপিয়ে নিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি শুনে বিশ্বাস করবেন না যে সেই উপন্যাস বাজারে এক কপিও বিক্রি হয় নি। তবু হাল ছাড়ছিলাম না। টগবগে তরুন তখন। রুমার উপর জেদটাও ভীষণ। তাই দীর্ঘ কয়েকবছর নিজের মনেই লেখালেখি চালিয়ে গেলাম। পত্রিকার চিঠিপত্র কলামেও লিখেছিলাম তখন। রাস্তা নির্মান চাই, গ্রামে একটা স্কুল দরকার- এইসব সমস্যা নিয়ে লেখা চিঠি অবশ্য কয়েকটা পত্রিকায় ছাপানোও হয়েছিল। নিয়ম করে লিখতাম তখন। আমার কেন জানি বিশ্বাস ছিল, নিয়মিত লিখতে থাকলে লেখালেখির হাত ভালো হবেই হবে।
ঘটনাটা দুই বছর আগের। দুই বছর আগের কোনো এক রাতে একটা গল্পের রাফ লিখে সকালে উঠে চূড়ান্ত করবো ভেবে ঘুমুতে গেলাম। যথারীতি সকালে ঘুম ভাঙার পর নাস্তা সেরে লেখার টেবিলে বসে দেখি, আমার রাফ লেখা গল্পটার এখানে সেখানে ঘষামাজা করে কে জানি চূড়ান্ত করে রেখেছে। হাতের লেখা আবার আমার হাতের লেখার মতোই। আমি এডিট করা পুরো গল্পটা আবার পড়লাম। পড়ে থ হয়ে বসে রইলাম। এমন লেখা আমার হাত থেকে বেরুনো প্রায় অসম্ভব। এতো চমৎকার গদ্যে লেখা ছিল গল্পটা যে আমার অবাক ভাবটা শেষ হতে বেশ কয়েক ঘন্টা লেগে গেলো। কে লিখে দিয়ে গেল এ গল্পটা আমি ভাবতে বসলাম। মেসে থাকি। আমার সাথে আরো দু-একজন থাকলেও গত রাতে মেসে কেউ ছিল না। আমি একাই ছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে, বিছানায় যাবার আগে রুমের দরজাও আমি খুব ভালো করে লাগিয়ে নিয়েছিলাম। তাহলে কে এমন কাজ করলো? ভাবতে ভাবতে যখন কূল আর কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন লেখাটা আবার পড়তে বসলাম। লেখক হবার চেষ্টায় ততোদিনে আমার অনেক পড়াশুনা হয়েছে। দেশি সাহিত্য শেষ করে বিদেশি সাহিত্যও পড়া হয়েছে অনেক, কিন্তু এমন ঘোর লাগানো ছোটগল্প আমি কখনো পড়িনি। তাই গল্পটা নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। লেখাটা দেশের জনপ্রিয় পত্রিকা প্রথম সকালের সম্পাদক বরাবর মেইল করে দিলাম। পত্রিকাটার সাহিত্য পাতা হচ্ছে দেশের ভেতর বহুল পঠিত পাতা। আমি জানি এই পাতায় গল্প ছাপালে তা রুমার চোখে পড়বেই পড়বে। এর আগে এই মেইল ঠিকানায় কতো কতো গল্প যে পাঠিয়েছি! কিন্তু আামর স্বপ্ন কখনো সত্যিতে পরিণত হয়নি। কিন্তু সেবার যা ভেবেছিলাম তার থেকেও অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল। পরদিনই পত্রিকার সাম্পাদক স্বয়ং আমাকে কল দিলেন। তার কথা শুনে স্পষ্টত বুঝতে পারছিলাম গল্পটি পড়ার পর তার ঘোরটা তখনও কাটেনি। গল্পের প্রশংসা করে নিয়মিত তার পত্রিকায় লিখতে বললেন। সম্পাদকের কল তো পাওয়া গেল কিন্তু রুমার তো কোনো খবর নেই। গল্পটি পত্রিকায় প্রকাশের পর অনেক অনেক লোকে যোগাযোগ করলো। রুমা যোগাযোগ করলো না। এতো লোকের প্রশংসা শুনে নিজে থেকে রুমাকে কল করাটাও আমার কাছে বেশ আপমানজনক বলে মনে হলো। মনে মনে ভেবে নিলাম, আমি আমার কথা রেখেছি, রুমা কী করলো না করলো সেটা দেখার বিষয় সম্পূর্ণ তার নিজের।
এরপর থেকে প্রতি সপ্তায় একটা করে ছোটগল্প লেখা শুরু করলাম। একই পদ্ধতি। একটা গল্প কোনোরকম দাঁড় করিয়ে টেবিলে রেখে দিতাম। পুরো সপ্তায় আমি আর ঐ লেখায় হাত দিতাম না। কোনো না কোনো রাতে সে এসে গল্পটা এডিট করে লিখে যেতো। এভাবে দিনকে দিন আমার খ্যাতি বাড়তে থাকলো। একসময় শুরু করলাম উপন্যাস লেখা। খন্ড খন্ড করে লিখে রাখতাম, সে এসে এডিট করে যেতো। এভাবে প্রায় চার চারটা ব্যাস্ট সেলিং উপন্যাস লিখে ফেললাম। ও হ্যাঁ, অস্বাভাবিক সেই ঘটনাটা শুরু হয়েছিল শেষ উপন্যাসটি লেখার সময়।
আবারো অস্বাভাবিক? আমি কথা না বলে থাকতে পারলাম না।
হুম। অস্বাভাবিক। এর আগে যেটা ঘটতো সেটা হচ্ছে আমি যা লিখে রাখতাম সেটাতেই সে কাটছাট করে নতুন করে লিখে দিতো। কিন্তু শেষ উপন্যাসে দেখলাম আমার লেখায় সে ছুঁয়েও দেখছে না।
তাই? তবে কি সে ঐ লেখাটাই হুবূহু রেখে দিতো।
না। সে সম্পূর্ণ আলাদা পৃষ্ঠায় আলাদা করে লিখে রাখতো যার সাথে আমার লেখার বিন্দুবিসর্গ মিল থাকতো না। এটাই আমার জন্য বড় রকমের একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো।
এতে আবার কী সমস্যা? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
সমস্যাটা আসলে আমার নিজের মধ্যকার। অন্যের লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেয়ার কারণে এতোদিন নিজের ভেতর একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। আগে তাও একটা স্বান্ত¡না ছিল যে, আমার লেখার উপরই কাটাঘষা করে সে একটা গল্প দাঁড় করাতো । কিন্তু এখন এখন যে উপন্যাসটা লেখা হচ্ছে সেটার কোনো অংশই তো আমার নিজের না। তাই খুব মর্মপীড়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। কতবার ভেবেছি যে এই উপন্যাসটা লেখা থামিয়ে দেই। কিন্তু গল্পের কাহিনীটা আমাকে এতো করে টানছিল যে আমি নিজেই এর ভালো একজন পাঠক হয়ে গিয়েছিলাম। তাই পড়ার খাতিরেই আমি লেখার প্রসেসটা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। অন্যদিকে, এমন একটা গল্প হাতছাড়া করারও ইচ্ছে হচ্ছিল না মোটেও। তাই গোপনে গোপনে চালিয়ে যাচ্ছিলাম প্রকৃত লেখককে হাতে নাতে ধরার চেষ্টা। তাকে ধরার জন্য পুরো এক সপ্তাহ আমার নির্ধারিত দৈনিক রুটিনটা পাল্টে ফেলেছিলাম।
দৈনিক রুটিন. সেটা আবার কিরকম?
হ্যাঁ দৈনিক রুটিন। অর্থাৎ, পাহারাদার হয়ে গিয়েছিলাম। পাহারাদারদের মতো দিনে ঘুমাতাম আর রাতে জাগতাম।
ধরতে পেরেছিলেন?
না, ঐ এক সপ্তাহ সে একেবারেই আসে নি। কিন্তু এক সপ্তাহ পর উপন্যাসের পরের পর্ব পড়ার জন্যও ছটফাটনি শুরু হয়েছিল। এমন তুমুল আগ্রহ কোনো গল্পের জন্য কখনো হয় নি। তাই আবার আমি আগের রুটিনে চলে গেলাম।
স্যার, তুরুপের তাস উপন্যাসটা আমাকে এক বসাতেই পড়তে হয়েছিল। এতোটাই ইন্টারেস্টিং ছিল গল্পটা। তারপর কী করলেন?
অবশেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে আমি পুরো রুমের সব কোনায় সিসি ক্যামেরা লাগানোর ব্যবস্থা করলাম।
সিসি ক্যামেরা লাগানোর খবর পেয়ে আমিও একটু নড়েচড়ে বসলাম। আমার মূল আগ্রহ তখন কে লেখকের হয়ে লেখাগুলো লিখছো সেটা জানা।
তিনি তার গল্প চালিয়ে যেতে থাকলেন।
ক্যামেরা লাগানোর তিনদিন পর আমি তাকে ধরতে পারলাম। যা দেখলাম তাতে আনন্দিত হবো কি না সেটা বুঝতে পারলাম না। দেখলাম, রাত ঠিক তিনটার দিকে আমি নিজেই বিছানা থেকে নেমে লিখে রাখা পৃষ্ঠাটা সরিয়ে লিখতে বসলাম! ঠিক পাঁচটা পর্যন্ত দুইঘন্টা লিখে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম!
ওহ! স্লিপ ওয়াকিং? (টার্মটা আমার জানা ছিল। )
হয়তো স্লিপ ওয়াকিং এটাকেই বলে।
ডাক্তার দেখাননি?
দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভয়ে দেখাইনি।
কিসের ভয়? আমি অবাক হলাম।
এটা যদি সত্যিই স্লিপ ওয়াকিং হয় আর ডাক্তার যদি আমাকে সুস্থ করে দেয়?
ও মা, আপনি বুঝি সুস্থ হতে চান না?
না, কারণ এটা যদি কোনো অসুস্থতাও হয় এটা এখন আমার জন্য একটা আশীর্বাদ। আমি এই অুসস্থতার কারণেই লেখক হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছি। আপনি জানেন, আমার ঘরে এখন কতো কতো পুরস্কার রাখা আছে? সাহিত্য সম্পাদক, প্রকাশক এরা এখন আমার বাসার দরজায় গিয়ে গল্পের জন্য, পান্ডুলিপির জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। আপনি বলেন, এমন সুখ্যাতি আপনি নিজে কি হারাতে চাইতেন?
লেখক বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন দেখে আমি আর কথা বাড়ালাম না। উনার কথায় যুক্তিও আছে অবশ্য। উনি এমন না লিখলে কি আমার মতো বোদ্ধা পাঠক উনার ভক্তে পরিণত হতো?
যাই হোক, তিনি তার গল্প চালিয়ে গেলেন।
ব্যাপারটা ধরতে পেরে আমি ভীষণ আনন্দিত হয়ে উঠলাম। তাহলে আমি এই উপসংহারে খুব সহজেই পৌছে গেলাম যে, আমি এ যাবত যতো লেখা লিখেছি তা তো আমার নিজেরই লেখা! এটা ভেবে বুকের ভেতর জমাট বাঁধা একটা অপরাধ বোধ যেন দীর্ঘশ্বাসের সাথে যেন বের হয়ে গেল। আমি সবগুলো ক্যামেরা খুশির চোট ভেঙে ফেললাম। একসময় শেষ হলো আমার শেষ লেখা উপন্যাস তুরুপের তাস। জানেন তো, এ উপন্যসটা বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছে?
জি, জানি। তারপর কী হলো।
তারপর? তারপর শুরু হলো নতুন সমস্যা।
আবার?
উপন্যাসটা শেষ করা মাত্র আমি একটা গল্প লেখা শুরু করলাম। পরপর দুটো উপন্যাস লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই মনে করলাম, এবার একটা ছোটগল্প লিখি। এর একমাস পরেই ছিল ঈদ। ঈদসংখ্যায় ছোটগল্প দেয়ার চাপ ছিল।
ঈদসংখ্যা? কিন্তু কোনো ঈদসংখ্যায় তো আপনার লেখা পেলাম না। আমি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।
না, গল্পটা এখনো শেষ হয় নি। তাই আমি আর কোনো গল্পও লিখতে পারছি না।
কী হয়েছে? আপনি কি তবে সুস্থ হয়ে গেছেন?
তিনি ভ্রæ কুঁচকে আমার দিকে তাকালে আমি মাথা নেড়ে বললাম, না, মানে, সে কি আর আসে না?
সে আগের মতোই নিয়ম করে আসে।
তাহলে?
অন্যরকম একটা সমস্যা হয়ে গেছে এখন। সে আসে ঠিকই। লিখতেও বসে নিয়ম করে। লিখেও রেখে যায়, কিন্তু গল্পটা শেষ হয় না। কয়েক পৃষ্ঠার পরেই গল্পটা আবার প্রথম থেকে শুরু হয়। সে এমনভাবে গল্পটা লিখে যে গল্পটার শেষ আমি খুঁজে পাই না কোথাও। তাই অপেক্ষা করছি, তার লেখাটা শেষ হবার।
আমি অবাক চোখে লেখকের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি জানালা দিয়ে পানের পিক ফেললেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, গল্পটা পড়তে পারলে বেশ ভালো লাগতো।
পড়বেন? গল্পটা আমার সাথেই আছে।
আমি পুলকিত বোধ করলাম। আমার প্রিয় লেখকের একটা অপ্রকাশিত গল্প পড়ার সুযোগ এভাবে পেয়ে যাবো হঠাৎ করে, এ আমি কখনো ভাবিনি।
লেখক আবার দাঁড়িয়ে উঠে উপরে রাখা তার অ্যাটাচিটা হাতে নিয়ে বসলেন। কালো সেই অ্যাটাচি থেকে কালো রঙের একটা ডায়েরি বের করে আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, পড়েন। এই ডায়েরির প্রথম গল্পটাই সেই গল্প।
ডায়েরিটা খুলে প্রথম পাতাটা বের করে লেখককে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম এটাই কি সেই গল্প। লেখক মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললে আমি পড়া শুরু করলাম-
তাড়াহুড়োর ঠেলায় ভুল করে ট্রেনের ভুল কম্পার্টমেন্টে উঠে হাতে নেয়া লাগেজের ভারে কুঁজো হয়ে লোকজনের ভীড় ঠেলতে ঠেলতে মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরে বুক পকেটে রাখা টিকেটের গায়ে লেখা ঢাকার ঢ নং বগিতে প্রবেশ করে ডানদিকের দেয়ালে লাল অক্ষরে লেখা সি- ১২ সংখ্যাটি দেখতে পাওয়ার পরে লাগেজটাকে মাথার উপরের র্যাকে রেখে সিটে বসার পরে পাশে তাকিয়ে যদি দেখেন সেখানে আপনার প্রিয় লেখক বসে আছেন তাহলে আপনাদের কেমন লাগবে জানি না, আমি কিন্তু সাথে সাথে এভারেস্ট জয়ের মতো পুলকিত হয়ে উঠলাম…
আজ আমি আমার জীবনের শেষ গল্প লিখতে বসেছি। আর কখনো লিখবো না আমি। এতো বড় সিদ্ধান্তের পেছনে আছে একটি চিঠি।
আগে চিঠিটা পড়েন, পরে বাকিটা বলব।
 
প্রিয় লেখক,
আপনি আমাকে চিনবেন না। একসময় আমি আপনার লেখার একজন গুণমুগ্ধ পাঠক ছিলাম। আপনি যদি শ্রেষ্ঠ দশজন ভক্তের তালিকা তৈরী করতেন, তবে আমার নামটি নিঃসন্দেহে প্রথমেই থাকতো। এ পর্যন্ত প্রকাশিত আপনার সবগুলো বইয়ের নাম আমি এক নিঃশ্বাসে বলে দিতে পারব। বলে দিতে পারব, সব কটি বইয়ের প্রধান চরিত্রের নাম। আরো বলতে পারব, আপনার কোন বই কাকে উৎসর্গ করেছেন। মুখস্থ বলতে পারব, কোন বই কোন বাক্য দিয়ে শুরু হয়েছে। আপনার সবকটি বই একসময় আমার সংগ্রহে ছিল। মনে পড়ে, ডিগ্রি ফাইনাল পার্টের অর্থনীতি পরীক্ষার আগের রাতে পড়াশুনা ফেলে শেষ করেছিলাম আপনার ‘নিশি পাওয়া মানুষ’ নামের বইটি। এতোটাই ভক্ত ছিলাম আপনার লেখনীর! কী এক দুর্নিবার আকর্ষণে আমি ছুটে যেতাম আপনার বইয়ের জগতে! আপনার বই পড়তাম আর পড়তে পড়তে হাসতাম। কখনোবা দুচোখ বেয়ে জল ঝরে পড়তো আমার। আমার অনুভূতি হাতে নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে পারত আপনার লেখনী! এমন শক্তিমান একজন লেখক আমাদের এ দেশে আছে, এ ভাবতেই গর্বে বুকটা ভরে উঠত। আপনার লেখার বিপরীতে কেউ কিছু বললেই কান্না পেতো আমার। আমাদের পরিবারের সবাই আমার এই পাগলামীর কথা জানতো। তাই কেউ আমাকে কোন গিফট দিতে চাইলে আপনার বইগুলোই বেছে নিত। আপনার বইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল আমি যখন কাস টুয়েলভে। আর আমার বিয়ে হয়, আমি ডিগ্রী পরীক্ষায় পাশের পরপরই। এখানে বলতে হয় যে, ডিগ্রী ফাইনাল আমার দুবার দিতে হয়েছিল। প্রথমবার আপনার বই পড়ে পরীক্ষা দেয়ার কারনে অর্থনীতিতে ফেল করেছিলাম!
বিয়ের পর আমার হাসব্যান্ডও জানতে পারেন আমার প্রিয় লেখক হিসেবে আপনার কথা। ব্যবসায়ী বলে কি না জানিনা, উনি আবার বই পড়া পছন্দ করতেন না। আপনাকে নিয়ে যখনই উনার সাথে গল্প করতে চাইতাম, উনি অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতেন। আমার আবার দিনে অন্তত একবার আপনার বই নিয়ে কারো না কারো সাথে কথা না বললে হতো না। আমার এই আচরনে উনি বিরক্ত হতেন। বলতেন, আমাদের এই ছোট্ট সংসারে তুমি আরেকজন পুরুষকে নিয়ে এসো না। তার কথায় আমার খুব অভিমান হতো। আমি ভেবে পেতাম না, আমার এই নির্দোষ লেখক প্রেমে উনার সমস্যাটা কী। মাঝে মাঝে আমি রাগ করে উনার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতাম। আমার এই রাগ দেখে উনি যে চরম বিরক্ত হতেন এটা বুঝতে পারতাম।
একদিন লইব্রেরীতে গিয়ে আপনার নতুন একটা বই কিনলাম। বইয়ের নাম ভালবাসার রকমফের। বাসায় ফিরে পড়তে গিয়ে অবাক হলাম। ওমা! এ যে দেখি আমার নাম! গল্পের নায়িকার নাম পারুল। আমার নামও পারুল। আরো আশ্চর্য বিষয় গল্পের পারুলের বাড়ি আমার বাবার বাড়ি একই জায়গায় ময়মনসিংহের গাজীপাড়ায়। কাকতালীয় এ মিল দেখে আমি খুব মজা পেলাম। গল্পে আপনি লিখেছেন পারুল নামের মেয়েটির সাথে আপনার একসময় পরিচয় ছিল। তাকে আপনি পড়াতেন। পড়াতে পড়াতেই তার সাথে আপনার প্রেম হয়ে যায়। সেই প্রেম কাহিনী তুমূল যখন, তখন বাঁধ সাধেন আপনার মা। শেষ পর্যন্ত মায়ের জয় হয়। পারুল নামের মেয়েটিকে চিরতরে দূরে ঠেলে দেন আপনি। চরম মর্মস্পশী সেই গল্পটি পড়তে পড়তে আমি দুপুরের নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়েছিলাম। সন্ধায় উনি যখন বাড়ি ফিরলেন তখন মাত্র বইটা পড়া শেষ করেছি। আমার চোখে পানি ঝরছে। আমার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে, আমি তাকে বইটি দেখালাম। আমি আসলে তাকে আপনার লেখার শক্তিটা দেখাতে চাচ্ছিলাম। একজন লেখক কতোটা ভাল লিখলে এভাবে তার পাঠককে কাঁদাতে পারে- চাচ্ছিলাম বিষয়টা উনি বুঝতে পারেন। তিনি বইটা হতে নিলেন এবং ঐ প্রথম তিনি আপনার বই পড়া শুরু করলেন। আমিও মনে মনে আনন্দিত বোধ করলাম এই ভেবে যে এবার তিনি বুঝতে পারবেন কেন আমি আপনার লেখার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি এক বসায় বইটি শেষ করে উঠলেন। আমি আশা করছিলাম এবার তিনি নিশ্চয়ই আপনার লেখার প্রশংসা করবেন। এখন থেকে আমি নিশ্চয়ই তার সাথে আপনার লেখা নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিতে পারব। মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। তিনি পড়া শেষে আমার দিকে তীর্যক এক দৃষ্টি দিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠলেন,
ও! তাহলে এই ঘটনা! তাইতো বলি উনি কেন লেখকের জন্য এতো পাগল।
আমি বললাম,
বুঝতে পারলে তাহলে! কী দুর্দান্ত একজন লেখক, তাই না?
দুর্দান্ত লেখক কিনা জানিনা। তবে এটা নিশ্চিত যে তিনি একজন দুর্ধর্ষ প্রেমিক। প্রেমিকাকে এমন প্রেমসুধা দিয়েছেন যে তার প্রেমিকা বিবাহিত জীবনেও তাকে ভুলতে পারছেন না।
আমি বুঝতে না পেরে বললাম,
তুমি কি বুঝাতে চাইছ?
থাক। ন্যাকা সাজার দরকার নেই। তুমি ব্যাপারটা আগে বললেই তো হতো। আমি তোমাকে বিয়ে করতাম না। আমি তো জোর করে বিয়ে করিনি তোমাকে।
এখানে আমাদের বিয়ের কথা আসল কেন?
এক লেখকের সাথে কি সব ফষ্টিনষ্টি করে তারপর আমাকে বিয়ে করেছ তুমি! তোমরা মেয়েরা না, পারও। তার বিষাক্ত কণ্ঠের কথাগুলো শুনে বুঝতে পারলাম তিনি গল্পের কাহিনীকে সত্যি বলে ধরে নিয়েছেন।
বই না পড়া মানুষ তিনি। তাকে তাই কিছুতেই বুঝাতে পারলাম না, আমার আর বইয়ের চরিত্রের নাম ঠিকানা মিলে যাওয়াটা নেহাৎ কাকতালীয়। তাকে অনেক বলেও বুঝাতে পরলাম না যে, লেখকরা মাঝে মাঝে প্রথম পুরুষে লিখেন গল্পে বিশ্বাসযোগ্যতা আনার জন্য। প্রথম পুরুষে লেখা মানেই ব্যাক্তিগত জীবনের সত্যি কোন কাহিনী নয়। এই লেখকের সাথে জীবনেও দেখা হয়নি আমার। আমি তাকে ব্যাক্তিগতভাবে চিনিও না। না, তিনি আমার কোন কথাই বিশ্বাস করলেন না।
ধীরে ধীরে তার সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকল। দরকার ছাড়া আর কোন কথা হতো না আমাদের। উপলব্ধি করতে পারলাম, আমার প্রতি তার ভালবাসা কমে যাচেছ ক্রমশ। আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। সব রাগ তখন আপনার উপর। আপনার লেখার কারনেই আজ আমাদের এ অবস্থা। আপনার একটি গল্পের কারনে আমার ভালবাসার মানুষটি (যার সাথে আমার সারা জীবনের বন্ধন) কে হারাতে বসলাম। আমার প্রিয় লেখক, আপনি ধীরে ধীরে পরিণত হলেন আমার ঘৃণার পাত্রে। আমি আপনার সবগুলা বই পুড়িয়ে ফেললাম একসময়। হ্যা, আমি আপনাকে চরম ঘৃণা করি। শুধু আপনাকে না, সব লেখকদেরকেই আমি ঘৃণা করা শুরু করি। দার্শনিক প্লেটো ঠিকই তার আদর্শ রাস্ট্রে কোন কবি রাখতে চাননি। কবিরা মিথ্যাকে খুব সুন্দর করে সত্যিতে পরিণত করতে পারে। কবি লেখকদের এ জগতে কোন স্থান হতে পারে না।
ঘৃণা করি আপনাকে। তবু আপনার কাছে একটা রিকোয়েস্ট আমার। রাখা, না রাখা আপনার ইচ্ছা। চরম অবহেলার মধ্যে আমি আমার বিবাহিত জীবনের ত্রিশটা বছর কাটিয়ে দিয়েছি। আজ আমার স্বামী মৃত্যু শয্যায়। তার মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে হলেও আমি তাকে বিশ্বাস করাতে চাই আপনাকে নিয়ে তার যে ধারণা সেটা ভুল। আপনি যদি দয়া করে একবার আসতেন, এসে নিজের মুখে যদি তাকে বিষয়টি বলতেন তবে কৃতজ্ঞ থাকতাম।
আমার বর্তমান ঠিকানা মানে আপনাকে যেখানে আসতে হবে – ইবনে সিনা, সিলেট, কেবিন নং- ৩০৮।
ইতি
পারুল।
চিঠিটা পড়ার পর মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল। আমার একটা লেখা এভাবে পারুল নামের মেয়েটির জীবনে দুর্দশা নিয়ে আসবে তা কল্পনাও করিনি কখনো। আমরা লেখকরা লেখালেখি করি মানুষকে আনন্দ দেয়ার জন্য। তার আনন্দ কেড়ে নেয়ার জন্য না। আমরা মানুষের জীবন থেকেই কাহিনী নিয়ে গল্প বানাই। সে গল্প কখনো মানুষকে সাময়িক আনন্দ দেয়, কখনো বা তার চোখে কিছুক্ষণের জন্য অশ্রু নিয়ে আসে। কিন্তু এভাবে একটা লেখার জন্য কারো জীবন তছনছ হয়ে যাবে এমনটা আমরা কখনো আশা করি না। আমি রাতের ট্রেনে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
সিলেট ইবনে সিনার রিসিপশানে পৌছে জিজ্ঞেস করলাম ৩০৮ নং কেবিনটি কোন দিকে। হঠাৎ পেছন থেকে একটি মেয়ে কণ্ঠ ভেসে আসল,
আরে! বাবু স্যার না!
পেছনে তাকিয়ে যাকে দেখলাম তাকে চিনতে আমার একটুও দেরী হল না। এ যে দেখি পারুল। এ যে সেই পারুল যাকে নিয়ে আমার সেই গল্পটা!
কিছুই আর বুঝতে বাকি থাকল না তখন। পারুল তখন কাস টেনের ছাত্রী। তাকে পড়াতাম আমি। পড়াতে পড়াতেই একসময় প্রেম হয়ে গেল দুজনের। সেই কাহিনীর সবটাই লিখা আছে আমার ‘ভালবাসার রকমফের’ বইটিতে। আগ্রহীরা বইটি সহজেই সংগ্রহ করে পড়তে পারবেন বলে সেই কাহিনীতে আর যাচ্ছি না। তবে আপনাদের একটা কনফিউশন দূর করার চেষ্টা করাটা উচিত বলে মনে করছি। আমি তখন এলাকায় বাবু নামেই পরিচিত ছিলাম। ছাত্ররা সবাই আমাকে বাবু স্যার বলেই ডাকত। আমার এখনকার লেখক নামটি একটু কঠিন ছিল বলেই কিনা জানি না, অনেকে মনে রাখতে পারত না। আর ক্লাস টেনের সেই অপরিণত বয়েসের মেয়েটির আমার আসল নামটি মনে না রাখাটা অথবা না জানাটা দোষের কিছু না। যাই হোক, আমার ভালবাসার সেই মানুষটা, যে মানুষটা আমার জীবন থেকে একেবারেই হারিয়ে গিয়েছিল তার জীবনটা আমার লেখার কারনে এমন দুর্বিষহ হয়ে গেছে এটা জানতে পেরে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিলাম না। সত্যিই এমনটা আমি চাইনি। আমি তো পারুল নামটি ব্যবহার না করলেও পারতাম। কিন্তু যখন আমি গল্পটি লিখি, তখন পারুলের জায়গায় আর কারু নাম লিখতে পারছিলাম না আমি। পারুলের নাম আর ঠিকানাটাই কেবল ঠিক রেখেছিলাম। গল্পে আমার জীবনের সত্যি ঘটনার বাইরেও আরো অনেক কথাই ছিল। আমি ভাবিনি বইটি পারুল পড়বে। এটাও আমার ভাবনার বাইরে ছিল যে পারুল আমার মতো তুচ্ছ এক লেখকের এতোটা ভক্ত হতে পারে।
স্যার, আমাকে চিনতে পারেননি? আমি পারুল! তার হাসি মুখের কথাগুলোয় সম্বিত ফিরে পেলাম।
ও পারুল বুঝি! কেমন আছো?
ভাল আছি স্যার। আপনি এখানে যে!
অনেক ভেবে তারপর বললাম, আমার পরিচিত এক রোগীকে দেখতে এসেছিলাম।
রোগী দেখা শেষ?
হ্যা, এখন যেতে হবে, পারুল। নয়তো গাড়ি মিস করবো। বলেই পারুলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে আসলাম।
এরপর থেকে আমার এ লেখক সত্ত্বার প্রতি একটা ঘৃণা ঢুকে গেছে মনে। তাই ঠিক করেছি, আর লিখব না আমি। বিদায় পাঠক।

তখনও ফেসবুক বাংলাদেশে এতোটা জনপ্রিয়তা পায় নি। অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের জন্য আমার মতো নেট-প্রেমিদের ভরসা ছিল ইয়াহু, এমএসএন ও বিডিচ্যাট.কমের চ্যাটরুমগুলো। আমার প্রিয় ছিল ইয়াহু চ্যাট। ইয়াহু চ্যাটরুম গুলো ছিল বিভিন্ন দেশের নামে। আমি বাংলাদেশে নামক চ্যাটরুমে ঢুকে সবার সাথে আড্ডা দিতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। 

এভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজনের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেকের সাথে এখনও যোগাযোগ আছে।
এভাবে চ্যাট করতে করতেই একবার হুট করে মাথায় একটা ভূত চাপে। ইচ্ছা জাগে ইউরোপিয়ানদের সাথে বন্ধুত্ব করার। কিন্তু আমার একার ইচ্ছে থাকলেই তো হবে না। ওদিক থেকেও সমান ইচ্ছে থাকতে হবে। তাই আমার আগ্রহে চ্যাটের শুরু হয় ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশ নামটা উচ্চারণ করার পরেই আর কোন রিপ্লাই পাই না ওপাশ থেকে। বুঝতে পারি, তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশের নাগরিকের সাথে আড্ডা চালিয়ে যাওয়াতে তাদের মোটেই ইচ্ছে নাই। বরং আমাদের তারা খুব অবহেলার চোখে দেখে। তাই একটা বুদ্ধি আঁটলাম। ইউকে চ্যাটরুমে ঢুকে অনেক খোঁজাখুজির পর একটা মনের মতো প্রোফাইল পিক পেলাম। প্রোফাইল পিকটা এন্ড্রু নামের বেশ হ্যান্ডসাম একটা ছেলের। সোনালী চুলের অধিকারী এন্ড্রুকে দেখলে যে কোন ইরোপিয়ান নারী কুপোকাত হয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। তাই আমি দেরি না করে এন্ড্রুর প্রোফাইল পিকটা কপি করে নিয়ে ঐ ছবি দিয়ে নতুন একটা আইডি খুললাম। আর নাম দিলাম টারমিনেটর। ঐ সময় টারমিনেটর ছবিটা খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
তো, আমি আমার নতুন পরিচয় নিয়ে ইউরোপিয়ান চ্যাট রুমে ঢুকে সুন্দর সুন্দর নাম আর প্রোফাইল পিক দেখে আবার নতুন করে তাদের মেসেজ দেয়া শুরু করলাম। প্রোফাইলে এন্ড্রুর ছবি থাকায় যথেষ্ট সাড়া পেলাম। মাঝে মাঝে তো আমাকেই তারা নিজে থেকেই মেসেজ পাঠাত। এভাবেই একসময় সারাহ্ এর সাথে পরিচয়। খুব একটা রূপসী না হলেও, দেখতে মন্দ না সে। তার সাথে চ্যাট করতে করতে একসময় বন্ধুত্ব হয়ে গেল। নিয়ম করে প্রতিদিন তার সাথে চ্যাট করা শুরু হল। সে আমার অবস্থান জানতে চাইলে আমি ম্যানচেস্টার সিটির কথা বললাম। আরো নির্দিষ্ট করে আমার অ্যাড্রেস জানতে চাইলে সুকৌশলে এড়িয়ে গেলাম। বললাম, আমরা তো নেট ফ্রেন্ড। এটাকে রিয়েল লাইফে নিয়ে আসার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। এভাবে প্রতিদিন আমরা আমাদের দৈনন্দিন ঘটনাবলী শেয়ার করতাম, ছেলেবেলার গল্প করতাম। তবে সবচে বেশি হতো মুভি রিভিউ অথবা কোন ইংরেজী সাহিত্যের বই নিয়ে অলোচনা। আমার আর তার পছন্দের এই দুইটা বিষয় মিলে যাওয়ায় তার সাথে আমার চালিয়ে যাওয়া বেশ সুবিধা জনক হয়েছিল। আমার আর তার প্রিয় বিষয় ছিল মুভি আর বই। আমি প্রচুর ইংরেজী ছবি দেখেছি । আর ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করায় আমার বেশ দখল ছিল এসব বিষয়ে।
একদিন সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, আই থিংক আই এম ইন লাভ উইথ ইউ। আমি জানতাম ওয়েস্টার্নদের কাছে ভালবাসায় পড়া আমাদের বাঙালিদের মতো দীর্ঘমেয়াদী কোন রোমান্টিসিজম না যে যাকে ভালবাসলাম তাকেই বিয়ে করতে হবে। কিন্তু এক পর্যায়ে আমি নিজেও বুঝতে পারলাম যে তার সরলতা আমার ভীষন ভাল লাগছে। আমি যে কেবল একটামাত্র প্রোফাইল পিকচার এতো বছর ধরে ইউজ করছি এটা নিয়ে কখনো কোন প্রশ্ন সে করেনি। কখনো আমার এক্সিসটেন্স নিয়েও কোন প্রশ্ন তার মনে জাগেনি। আমি যা বলতাম তাই সে বিশ্বাস করতো অবলীলায়।
আমাদের সম্পর্ক তখন তিন বছর। সে প্রায়ই বলতো যে সে আমাকে সরাসরি দেখতে চায়। আমাকে কাছে পেতে চায়। তার নাকি আর তর সইছে না। সত্যি কথা বলতে লজ্জা নেই। আমিও আসলে তাকে খুব কাছে পেতে চাইছিলাম। নিজের করে পেতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার তো কোনো উপায় ছিল না। আমার পরিচয় জানতে পারলে সে আর কোনো দিনও আমার সাথে কথা বলবে না। আমি নিশ্চিত করে জানি এটা। তারপর আবার নিজেকে নিজেই প্রবোধ দিলাম এ বলে যে এতোদিনে যে মেয়েটা আমাকে না দেখেই ভালবাসার কথা বলল, কাছে চাইল, সে তো তবে নিশ্চয়ই আমার শারীরিক সত্ত্বার প্রেমে পড়েনি। সে তো তবে আমার মনটাকেই ভালবেসেছে। তার কাছে হয়তোবা বাইরের দিকটা কোনো ব্যাপার না। তাই একদিন সাহস করে সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিলাম। ওয়েব ক্যাম নিয়ে চ্যাটে বসলাম। ক্যাম অ্যাভেইলেবল দেখে সারাহের আনন্দের আর শেষ নাই। খুব উত্তেজনা নিয়ে ক্যাম ওপেন করতে বলল। আমিও সাত-পাঁচ কিছু না ভেবেই দিলাম ক্যাম অন করে।
১ সেকেন্ড.. ৫ সেকেন্ড… ১৫ সেকেন্ড… ৩০ সেকেন্ড— ১ মিনিট—
আমি দেখতে পারছিলাম সারাহের চোখ বড় হয়ে যাওয়া, চোখে অবিশ্বাস তৈরী হওয়া.. স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম সারাহের মুখের কোমল পেশীগুলোর ক্রমশ শক্ত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা…
-হু দ্যা হেল আর ইউ? ইজ ইট স্যাম, মাই স্যা…ম??
-ইয়েস… ইট ইজ মি… আই অ্যাম আফজাল। আফজাল হুসেইন।
তাকে জানালাম। আমি বাংলাদেশি। আমার নাম আফজাল। আমার স্যাম পরিচয়টা মিথ্যা। বিহাউন্ড স্যাম, বিহাইন্ড টারমিনেটর, ইট ইজ আফজাল। মিথ্যা বলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলাম।
সে আমাকে প্রশ্ন করল তার সাথে কেন এমনটা করলাম।
উত্তরে তাকে সত্যি কথাটাই বললাম। বললাম, আমি মিথ্যে না বললে সে নিশ্চয়ই আমার মতো ব্ল্যাকির সাথে কথা বলতো না। তাকে আরো জানালাম, আমার গায়ের রং হয়তো অন্যরকম। আমি হয়তো স্যাম নামের কেউ না। কিন্তু তার জন্য আমার যে ভালোবাসাটা সেটা মোটেও মিথ্যা না।
-টারমিনেটর, ইউ হ্যাভ রিয়েলি টারমিনেটেড মাই লাইফ। একথা বলেই সে সাইন আউট করে চলে গেল। আমি বুঝলাম সে আর কখনো সাইন ইন করবে না। সে কখনো আর আমাকে ভালবেসে আমার জন্য ওয়েইট করবে না।
পরপর কয়েকদিন আমি আর নেটে গেলাম না। সারাহ নাই। তো কি আর হবে ইয়াহু চ্যাট করে? অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
এক মাস পর হঠাৎ করেই একদিন মন খারাপ বোধ করায় সারাহের ছবি দেখার জন্য ইয়াহুতে সাইন ইন করতেই আমার চোখ চড়ক গাছ!
-স্যাম হোয়ার আর ইউ?
-স্যাম আই কান্ট লিভ ইউ।
-প্লিজ কাম ব্যাক।
এরকম শতশত অফলাইন মেসেজে ভরে আছে আমার চ্যাট বক্স! ইয়াহু!! অ্যাট লাস্ট আই গট সারাহ! অবশেষে আমি সারাহকে পেলাম। আবার শুরু হল আমাদের অনলাইন প্রেম। এবার ভয়েস চ্যাট। বয়েস চ্যাটের মাধ্যমে আমি তাকে বাংলাদেশের সাথে, বাংলা ভাষার সাথে পরিচয় করানোর চেষ্টা করলাম। ভীষণ মেধাবী মেয়ে সারাহ খুব অল্প দিনের মধ্যেই বাংলা ভাষাটা আয়ত্ব করে ফেলল। ক্রমশ আমরা দুজন আরো কাছাকাছি এলাম। এবং সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি ব্রিটিশ অ্যামবিসিতে উঠলাম। কিন্তু ব্রিটিশ অ্যামবেসি আমার ভিসা অ্যাপ্লিকেশন রিজেক্ট করল। তখন সারাহ ঠিক করল সে নিজেই একেবারে চলে আসবে বাংলাদেশে। আমি সানন্দে রাজি হলাম।
দীর্ঘ পাঁচ বছর অনলাইন প্রেম করার পর সারাহর সাথে আমার দেখা হবার দিনক্ষণ ঠিক হল ৫ জানুয়ারী, ২০১৫ তারিখ। সে ঐদিনই বাংলাদেশে পৌছাল। আমি তাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট যেতে চাইলাম। কিন্তু সে নিষেধ করল। বলল, সে নিজেই একা একা এয়ারপোর্ট থেকে আমাদেও বাসা ফার্মগেট পৌছাতে পারবে। প্রথমে ব্যাপরটা না মানলেও তার উৎসাহ দেখে মেনে নিতে বাধ্য হলাম।
-ওকে। একাই আসো। কোনো সমস্যা নাই। কেবল সমস্যায় পড়লে মোবাইলে কল দিতে ভুলে যেও না।
এয়ারপোর্ট থেকে নেমে সিএনজিতে উঠেই সে পড়ল ট্রাফিক জ্যামে, তারপর পড়ল বিরোধী দলের সাথে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ভেতর। ককটেল আর গুলির শব্দে ভয় পেয়ে আমাকে কল দিল।
আমি তড়িঘড়ি ছুটলাম। তাকে উদ্ধার করলাম। সে তখন ভয়ে কাঁপছে।
-হোয়াট দ্যা হেল দ্যা আর ডুইং? ডু ইউ বেঙ্গলিজ ফাইট অল দ্যা টাইম?
আমি বললাম, না সবসময় না। এখন তো অবরোধ চলছে। তাই এমন।
বাড়ি ফেরার পথে তাকে বুঝালাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা এখন খুব খারাপ। এখানে প্রায়ই বিরোধী দল আর সরকারি দলে মারামরি হয়। নিরীহ মানুষেরা মারা যায়। বুঝালাম অবরোধ মানে সবরকমের যোগাযোগব্যাবস্থা বন্ধ করে দেয়া। মানুষের চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি করে সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করা।
সে জিজ্ঞেস করল, অবরোধ কবে শেষ হবে।
জানালাম এবারের অবরোধ অনির্দিষ্ট কালের জন্য।
-অনির্দিষ্ট কাল মানে কী?
-অনির্দিষ্টকাল মানে যে সময়ের কোন শেষ নেই। যে অবরোধ পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত চলতে থাকবে তাকেই অনির্দিষ্ট কালের অবরোধ বলে। পরবর্তী ঘোষণা কবে আসবে সেটারও কোন ঠিক নেই।
সে বলল, ইন নো ওয়ে! আমি আনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত এই অস্বাভাকি অবস্থায় থাকতে পারব না। আমি তোমার জন্য দেশ ছাড়তে পারব, ধর্ম ছাড়তে পারব, কিন্তু জীবন ছাড়তে পারব না স্যাম। আগে এ দেশটাকে ঠিক করো, তারপর আমি আসবো।
পরের কয়েকটা দিন তাকে বুঝাবার চেষ্টা করলাম যে,আমার একার পক্ষে এটা ঠিক করা সম্ভব না। অমি অতি সাধারন এক নাগরিক। আমি একা কিভাবে পুরো দেশটাকে ঠিক করে ফেলব। একদিন না একদিন এ আপনা-আপনি ঠিক হবে। তাকে আশ্বস্ত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। তার এক কথা, যে দেশের সাধারণ জনগণ এমন অবস্থায় ইট পাখির মতো মাথা গুঁজে বসে থাকে সে দেশের উন্নতি কোনদিনও হবে না। সে আমাকে কাঁদিয়ে এক সপ্তাহ পরেই ফিরে চলে গেল তার দেশে।
-তারপর? উপস্থাপিকা প্রশ্ন করলেন।
-তারপর? তারপর থেকেই আমার রাজনীতিতে নামা। এবং আপনাদের সকলের ভালবাসায় আজ আমাদের দল এ দেশের নির্বাচিত সরকার।
-এই যে বিরোধীরা প্রতিবাদ করছে, বলছে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
-আমার কী কথা আবার? ভোট দিয়েছে জনগণ। তারা কারচুপি করেছে কিনা এটা তো আমার জানার কথা না।
-বিরোধী দলগুলো যদি হরতাল, অবরোধ দেয় আপনারা কী করবেন? মানে শুরুতেই যদি এমন প্রতিক’ল অবস্থায় পড়ে যান, তবে কি ভাল হবে?
-তারা হরতাল দিলে আমাদের কী করার আছে বলেন? বড়জোড় ওদের যুক্তি-তর্ক দিয়ে বুঝাতে পারি। যুক্তি দিয়ে, ভাল ব্যবহার করে, তাদের ভুল ধারনা ভাঙতে পারবো বলেই আমার বিশ্বাস।
-আপনারা কি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য নিবেন বিগত সরকারগুলোর মতো?
-অবশ্যই না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে কখনো প্রভাবিত করা হবে না। তারা স্বাধীন থাকবে। আর আমি মনে করি, বিরোধীকে বলতে দিতে হয়। ওরা বলবে। খারাপ কিছু দেখলে তারা অবশ্যই প্রতিবাদ করবে। সে অধিকার তাদের আছে। আবার এটাও বিশ্বাস করি, অযথা ক্ষমতার লোভে কোন প্রতিবাদ কখনো সফল হয় না। ইতিহাস থেকে আমরা জানি, যেসব বিপ্লবে সৎ উদ্দেশ্য থাকে, সেই বিপ্লবই সফল হয়।
-তাহলে আমরা ধরে নেব যে আপনারা অসৎ উপায়ে ক্ষমতায় আসেননি।
-আপনার কি ভাববেন আর না ভাববেন- সেটা আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। যদি মনে করেন আমরা অযোগ্য তবে আগামী ভোটেই রায় দিয়ে আমাদের তাড়িয়ে দেবেন। ক্ষমতাতো জনতার হাতেই আছে। আমরা কেবল এ ব্যাপরাটারই নিশ্চয়তা চাই যে গণতন্ত্রে ক্ষমতা সবসময় জনতার হাতে।
-তবে এই মুহ’র্তে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আপনাদের পরিকল্পনা কি?
-ক্ষমতার জন্য? খুব সহজ। আমরা জনগণের জন্য কাজ করে যাব। জনগণের উন্নয়নের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আমাদের। আরেকটা কাজ করব। নির্বাচন প্রক্রিয়াকে খুব স্বচ্ছ ও নিশ্ছিদ্র করার চেষ্টা করব। নির্বাচনটা যদি যথা সময়ে এবং নিরপেক্ষ হয় আর আমরা যদি সবাইকে নিয়ে ভাল কিছু করতে পারি তবে জনগণ নিজেরাই ঠিক করবে আমাদের ক্ষমতায় রাখবে কি না।
এভাবেই লাইভ টিভি প্রোগ্রাম শেষে নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জনাব আফজাল টিভি স্টুডিও থেকে বের হলেন। তখনই তার মোবাইলের রিং টোন বেজে উঠল। সারাহ!
-কনগ্রেটস আফজাল! মাই গুডনেস! নিউজে দেখলাম তুমি প্রধানমন্ত্রী! অ্যাট লাস্ট ইউ ডিড ইট! বাট হাউ!
-সারাহ! আই ক্যান্ট ইমাজিন! থ্যাংক ইউ সারাহ! পরে সব বলব। আফজালের গলা আদ্র হয়ে গেল। দীর্ঘদিন ধরে সারাহ এর সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না।
-বাই দ্যা বাই।এখন কি আর তোমাদের পলিটিশিয়ানরা ফাইটিং করবে?
-না। একদম না সারাহ্! আমি সবাইকে নিয়ে কাজ করব। এখন থেকে সরবারি বা বিরোধী উভয়ের থাকবে সমানাধিকার। ফাইটিং যাতে না করতে হয় সে ব্যবস্থা করব। হিংসা বিদ্বেষের রাজনীতি আমি নির্মুল করবোই করব।
– আর কোনো অবরোধ হবে?
-অবশ্যই না। আমি এমন ভাবে রাস্ট্র পরিচালনা করব যে বিরোধীদের হরতাল অবরোধ দরকার পড়বে না। ইনফ্যাক্ট আমি বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের পলিটিক্যাল কালচারটাই চ্যাঞ্জ করে ফেলব। আই স্যোয়ার সারাহ! আই সোয়্যার!
-তবে আমি আসছি আফজাল। আমি আবার বাংলাদেশ আসছি। ইফ…ইফ ইউ আ’ উইলিং টু এক্সেপ্ট মি।
-তুমি আসবে সারাহ? তুমি আবার আসবে?
-অবশ্যই। অবশ্যই আসব। তবে সেটা হবে অনির্দিস্ট কালের জন্য!

এটা ঠিক যে তখন তীব্র গরম পড়েছিল, রিক্সা না পেয়ে অনেকন হাটতে হাটতে বেশ কান্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং রাস্তার যে পাশে আমি দাঁড়িয়েছিলাম তখন তার উল্টোদিকের বড় দোকানটির সাইনবোর্ডের নীচে ছোট্ট করে লেখা ছিল ‘সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত’ কথাগুলো।

তবু যদি দোকানটির কাঁচের গ্লাস ভেদ করে ভেতরে সুন্দরী তিন সেলস গার্লকে না দেখতাম তবে হলফ করে বলতে পারি ঐ দোকানটিতে এটা সেটা দেখে কিছুক্ষণ এসির হিমেল ঠান্ডা বাতাসের লোভ আমি সামলে নিতে পারতাম ঠিকই।
দোকানে ঢুকতেই সেলস গার্লদের একজন তার মোহন ভুলানো রমনীয় হাসি হেসে আমাকে বলল, সুপ্রভাত স্যার, কী চাই স্যার?
চাই তো তোমার কাছ থেকে অনেক কিছুই কিন্তু চাইলেই যদি দিতে!
মনের কথা মনেই রেখে বল্লাম, থ্যাংক ইউ। আগে আমি ডিসপ্লেগুলো দেখি। পছন্দ হলে জানাবো।
ওকে স্যার। আপনি দেখুন।
ওটা ছিল একটা কাপড়ের দোকান। সারি সারি কাপড় ডিসপ্লেতে ঝুলানো। পুতুল ও আছে কয়েকটা। ছেলে পুতুল, মেয়ে পুতুল। এসব পুতুলকে কি জানি বলে সেটা মনে করতে পারলাম না। তবে পুতুলগুলো যিনি বানিয়েছেন তার প্রশংসা করতেই হয়। কি নিখুঁত দেহের অধিকারী পুতুলগুলো! সেলস গার্লসরাও অবশ্য যথেষ্ট সুন্দরী এবং স্মার্ট। আমি কাপড় দেখার পাশাপাশি আঁড়চোখে তাদের দেখছিলাম। আমি ছাড়া আর কোন ক্রেতা না থাকায় তারা চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল।
কাপড়টা পছন্দ হয়েছে স্যার? মেয়েদের একজনের এই প্রশ্নে ভাবনায় বিরতি দিতে হল।
কোন কাপড়টা?
ঐ যে.. যেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন?
ওহ! আচ্ছা। দেখি আমার সামনে একটা স্যুয়েটার টানানো।
এটাতো একটা স্যুয়েটার?
জ্বি স্যার। মাঝে মাঝে ট্যুরিস্টরা আসে এদিকে ঘুরতে। তারা মাঝে মাঝে শীতের কাপড় খুঁজে। এখন গরমের সিজন হলেও তাই ওটা ডিসপ্লেতে রাখা।
ও আচ্ছা! আমি অন্য কাপড়ের দিকে দৃষ্টি দিলাম তাড়াতাড়ি!
স্যার, আপনাকে কিন্তু অনেক ভাল্লাগবে ওটা পরলে।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম।
ভাল্লাগবে? আমাকে?
জ্বি স্যার। অনেক সুইট লাগবে।
মেয়েটির হাসিটা সত্যি সুইট। আর এমন করে আগে কেউ আমাকে বলেনি কথাগুলো।তাই তার কথাগুলোও আমার কাছে মিষ্টি লাগল।
দাম কতো এটার? দাম করতে তো কোন সমস্যা নেই। এতে বরং মেয়েটির সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে।
মেয়েটি কাপড়টি হাতে নিয়ে কি যেন দেখল। দাম বেশী না স্যার। মাত্র এক হাজার দুইশ টাকা।
এক হাজার দুইশ টাকা আমার পকেটে আছে। কিন্তু আমি তো কিছু কেনার জন্য এখানে আসিনি। তাছাড়া গরমে স্যুয়েটার কেনার প্রশ্নই আসে না।
আমি অন্যমনস্ক হবার ভান করে হাটতে হাটতে দোকানটির অন্য কোনায় চলে গেলাম।
এবারে দ্বিতীয় সেলস গার্ল এগিয়ে আসল।
স্যার, কাপড়টা কিন্তু খুব ভাল স্যার । এটা পড়লে মোটেও শীত লাগবে না। আপনি নির্দ্ধিধায় এটা কিনতে পারেন।
মেয়েটির দিকে ভাল করে তাকালাম। নাছোড়বান্দা মেয়েটি দেখি ভয়াবহ সুন্দরী। ঠিক যেন সূচিত্রা সেনের কার্বন কপি!
বল্লাম, কাপড়টা পছন্দ হয়েছে ঠিক। কিন্তু এখন তো গরম। শীতে কিনব।
এটা কি বলেন স্যার! এখন কিনে রেখে দিন। শীতে পড়বেন। তাছাড়া শীতে তো এটার প্রাইস আরো বেড়ে যাবে।
মেয়েটির কঠিন যুক্তি!
তাই নাকি? আচ্ছা আমি অরেকটু দেখব।
আর দেখতে হবে না স্যার। আপনার তো স্যার নায়ক নায়ক চেহারা। এটা পড়লে একেবারে শাহরুখ খানের মতো লাগবে।
নায়ক নায়ক চেহারা! বলে কি! এখন পর্যন্ত কোন মেয়েকেই আমার দিকে দ্বিতীয়বার চোখ তুলে তাকাতে দেখিনি। আর এ মেয়েটা বলে কিনা আমি নায়কের মতো দেখতে!
স্যার, একবার পরে দেখেন না স্যার। ভাল না লাগলে কিনবেন না।
পরতে তো আসলেই কোন সমস্যা নাই। পরার পর ভাল লাগে নাই বলে রেখে দিব। পরলাম। তিন তিনটা সুন্দরী মেয়ের সামনে কাপড়টা পরতে অনেক লজ্জা লাগল যদিও।
ক্যাশ কাউন্টারে বসা মেয়েটি এবার ডাকল। এদিকে আসুন স্যার। এখানে লুকিং গ্লাস আছে।
লুকিং গ্লাসে নিজেকে দেখতে তো কোন সমস্যা থাকার কথা না। গেলাম লুকিং গ্লাসের সামনে। তাকালাম নিজের দিকে। পেছন থেকে কাউন্টারের মেয়েটি বলল, দেখুন স্যার। কি চমৎকার লাগছে আপনাকে। স্যার কি ব্যায়াম করেন?
ব্যায়াম! আয়নায় মেয়েটির দিকে তাকালাম। এওতো দেখি কম সুন্দরী না। চোখ দুটি যেন জীবনানন্দের পাখির নীড়ের মতো!
ব্যায়াম না করলে এতো সুন্দর ফিগার হয় কি করে স্যার? মেয়েটি আবার বলল।
বললাম, হ্যা একটু আধটু ব্যায়াম আমি করি বটে। হাটাহাটি আরকি!
তাই তো বলি স্যার। হাটার উপর আর কোন ব্যায়াম আছে নাকি! স্যার, আমি বলি কি, কিনে নেন স্যুয়েটারটা। ভাল হবে।
ভাল হবে বলছেন?
অবশ্যই স্যার। আমার তিন তিনজন মেয়ের চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে আপনাকে দেখে। ভাল হবে না তো কি হবে? দেখবেন, সবাই খুব প্রশংসা করবে।
কিন্তু শীত আসতে এখনো আরো ৫ মাস!
৫ মাস কোন সময় হল স্যার! লাভের জন্য মানুষ কতো কিছুই না করে। দেখেন না, শেয়ার বাজারে মানুষ ইনভেস্ট করে দু’বছর ধরে বসে আছে লাভ পাবার জন্য?
তাইতো! আমারই এক বন্ধু দু বছর আাগে ইনভেস্ট করেছিল লাখ টাকা। সেদিন বলছিল, এখন ছাড়লে ৫০ হাজার টাকা লস করতে হবে। লাভের জন্য আরো এক বছর ওয়েইট করতে রাজী। মেয়েটার তুলনা করার মতার প্রশংসা করতেই হয়!
বললাম, কিন্তু দামটা কি বেশী হয়ে যাচ্ছে না।
ওকে স্যার। এটা ফিক্সড প্রাইসের দোকান। তবু গরমের দিনে শীতের পোষাক কিনছেন বলে আপনাকে আমরা একশ টাকা অনার করছি, স্যার।
তিন জনই এখন আমাকে ঘিরে আছে। এই ঘেরাটোপ থেকে বেরুতে হবে আমাকে। দেরী হয়ে যাচ্ছে আমার। আর কোন কথা না বলে পকেট থেকে তিনটি পাঁচশ টাকা বের করে দিলাম। ক্যাশের মেয়েটি আমাকে চারটি একশ টাকা ফিরত দিল।
টাকাগুলো মানিব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বের হয়ে খেয়াল হল গায়ে তখনো স্যুয়েটারটি পরে আছি আমি। আরো খেয়াল করলাম, সারা শরীর আমার ঘেমে একাকার! অথচ দোকানটি ছিল কিনা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত!